দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ। এই বাজারের বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি হচ্ছে নুরজাহান গ্রুপ। এক সময় মাররিন ভেজিটেবল অয়েলস লিমিটেড, নুরজাহান সুপার অয়েল লিমিটেড, জাসমির ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেডসহ গ্রুপটির ছিল ২০টির মতো কোম্পানি। ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার উদ্দেশ্যে একের পর এক এসব কোম্পানি খোলা হয়। দেখা গেছে, কোম্পানি খোলার কয়েক বছরের মধ্যে সেই কোম্পানির আর অস্তিত্বই মেলেনি।
আদালত বলছেন, ব্যাংকগুলোর দাবি, আদালতে চলা মামলায় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন রতন। কিন্তু এই টাকা পরিশোধে ছিল না তার কোনো আগ্রহই। যে কারণে ছয় হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের একাধিক মামলার পরোয়ানা থাকায় দেশের অন্যতম এই ঋণখেলাপিকে ২০২৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর ঢাকার বাড্ডা থেকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানা পুলিশ।
শুধু তিনিই নন, তার অন্য দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধেও রয়েছে একই ধরনের অভিযোগ। ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে রতনের আরেক ভাই ঋণখেলাপি টিপু সুলতানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন। এর পাশাপাশি একই অভিযোগে জনতা ব্যাংকের ৩২৬ কোটি টাকা আত্মসাতে তাদের আরেক ভাই ফরহাদ মনোয়ারের বিরুদ্ধে রয়েছে পাঁচ মাসের আটকাদেশ। জহিরের স্ত্রী আসমিন মনোয়ারা ওরফে তাসমিন আহামেদ সন্তানসহ বসবাস করেন কানাডায়। তবে তাদের ঋণের এই টাকা কে কীভাবে পরিশোধ করবেন, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি স্পষ্ট কোনো ধারণা।
জানা গেছে, নুরজাহান গ্রুপের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) নামে ২০টি ঋণখেলাপি এবং ৪৪টি চেক প্রতারণা, দুর্নীতি ও ভেজাল খাদ্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলা আছে। এই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী পুলিশের হাতে ৬৪টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে। যার মধ্যে ২৮টিতে সাজা হয়েছে। ৩৩টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরোয়ানা পেন্ডিং ছিল নগরের পাঁচলাইশ থানা পুলিশের হাতে ২৭টি, কোতোয়ালি থানায় ২৪টি, খুলশী থানায় পাঁচটি, পাহাড়তলী থানায় পাঁচটি এবং নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানায় তিনটি।
ঋণ পেতে খোলা হয় নামমাত্র কোম্পানি: নুরজাহান গ্রুপ ব্যবসা শুরু করে তেল আমদানি, পরিশোধন, উৎপাদন ও বাজারজাতের মাধ্যমে। এসব ব্যবসায় তারা কিছুটা সফল হওয়ার পর একসময় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে টাকা হাতানোর নেশায় জড়িয়ে পড়ে। খোলা হয় নতুন নতুন কোম্পানি, যার বেশিরভাগই নামমাত্র। মূলত ঋণ নিতেই এসব কোম্পানি খোলা হয়—এমন অভিযোগও ওঠে। দেখা গেছে, কোম্পানি খোলার কয়েক বছরের মধ্যে সেই কোম্পানির আর অস্তিত্বই মেলেনি। অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের নামে এভাবে অন্তত ২০টি কোম্পানি খোলা হয়।
এর মধ্যে রয়েছে নুরজাহান সুপার অয়েল লিমিটেড, ম্যারিন ভেজিটেবল অয়েলস লিমিটেড, জাসমির ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেড, জামিয়া এডিবল অয়েল লিমিটেড, জামিয়া সুপার অয়েল লিমিটেড, জামিয়া ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেড, নুরজাহান সিনথেটিক লিমিটেড, সাগরিকা বোতল অ্যান্ড প্যাকিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, তাসমিন ফ্লাওয়ার মিলস লিমিটেড, নুরজাহান স্পাইসিস লিমিটেড, নুরজাহান ব্রিকস লিমিটেড, তাসমিন প্রপার্টিজ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, নুরজাহান ট্যাঙ্ক টার্মিনাল লিমিটেড, আহমেদ ট্রেডার্স, আরওয়াই শিপিং লাইনস লিমিটেড, নুরজাহান সিএনজি রি-ফুয়েলিং স্টেশন লিমিটেড, সুফি অ্যান্ড ব্রাদার্স, লাহিড়ি এন্টারপ্রাইজ।
এদিকে এসব বিষয় নিয়ে জানতে নুরজাহান গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (ফ্যাক্টরি) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুনকে জিজ্ঞেস করলে তিনি অফিসে আসার অনুরোধ জানান। কালবেলাকে তিনি বলেন, মোবাইলে এই ধরনের কোনো তথ্য দেওয়া সম্ভব নয়। আপনি অফিসে এলে সব বলব। আমরা এখন মরা কোম্পানি।
যে ব্যাংকে যত ঋণ: পুরোনো ফাইল থেকে গেছে জানা গেছে, নুরজাহান গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান জাসমির ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেড ১১২ কোটি ৪৭ লাখ ৬২ হাজার ৮০১ টাকা ঋণ নেয় জনতা ব্যাংক লালদীঘি শাখা থেকে। ঋণের টাকা পরিশোধ না করায় তা সুদ, দণ্ড সুদসহ ৩২৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকায় দাঁড়ায় ২০২২ সালেই। যে কারণে ওই বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি এই পাওনা আদায়ের জন্য পাঁচ মাসের কারাদণ্ড দেন অর্থঋণ আদালত।
তখনকার নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেড জুবিলী রোড শাখা থেকে নুরজাহান গ্রুপের দুই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান প্রায় ২৯৭ কোটি টাকা নিয়েছে। এর বিপরীতে বন্ধকী সম্পত্তির মূল্য ৪০ কোটি টাকা হতে পারে।
নুরজাহান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির আহমদ রতন মেসার্স আহমদ ট্রেডার্সের নামে ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ১১৮ কোটি ৫০ লাখ ৫১ হাজার ৮৮৩ টাকা ঋণ নেন। এ ঘটনায় ২০২০ সালে মামলা দায়ের করা হয়। ঋণের বিপরীতে কোনো স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক না থাকায় বাদীপক্ষ তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আবেদন করে। আদালত তার বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ৮ নভেম্বর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
এর বাইরে সাউথইস্ট ব্যাংকের চারটি মামলায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ছয়টি মামলায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের চারটি মামলার মধ্যে তিনটির রায় হয়েছে। এগুলোতে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের দুটি মামলায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকাসহ বিভিন্ন মামলায় তাদের খেলাপি ঋণ রয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকার ওপর।
দুদকের অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য, তবে এগোয়নি তদন্ত: বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির বিপরীতে নুরজাহান গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ম্যারিন ভেজিটেবল অয়েলস লিমিটেড অগ্রণী ব্যাংক থেকে ঋণের নামে ২৫৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। এমন অভিযোগে কয়েক বছর আগে নুরজাহান গ্রুপের দুজন আর তিন ব্যাংক কর্মকর্তাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর আগে ২০১৯ সালের ৩ এপ্রিল এ বিষয়ে সহকারী পরিচালক নিয়ামুল আহসান গাজী বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেছিলেন।
নথি ঘেঁটে দুদকের তদন্তে দেখা গেছে, ২০১১ সালের ১০ মার্চ ম্যারিন ভেজিটেবল অয়েলস অগ্রণী ব্যাংকের চট্টগ্রামের একটি শাখায় ৩৫ হাজার মেট্রিক টন ক্রুড পামওলিন আমদানির জন্য ২০ শতাংশ মার্জিনে ১২০ দিন মেয়াদে প্রায় ৩২৭ কোটি ৪ লাখ টাকা ঋণপত্র এবং মার্জিন ২৬১ কোটি ৬৩ লাখ টাকার টিআর ঋণের জন্য আবেদন করে। ম্যারিন ভেজিটেবল অয়েলসকে ঋণ নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক শর্ত দেয়, নুরজাহান গ্রুপের আরেক অঙ্গপ্রতিষ্ঠান জাসমির ভেজিটেবল অয়েলসের কাছে অগ্রণী ব্যাংকের আছাদগঞ্জ শাখায় ২০১২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮৫ কোটি ৯৭ লাখ ৭৭ হাজার ১৮ টাকার অনাদায়ি ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
দুদকের তদন্তে পরে উঠে আসে, অগ্রণী ব্যাংকের আগ্রাবাদ জাহান ভবন শাখা থেকে ম্যারিন ভেজিটেবল অয়েলসের অনুকূলে ঋণের নামে ২০১১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মোট ২৮০ কোটি ৭২ লাখ ৩৮ হাজার ৩৭৩ টাকা কোনো শর্ত না মেনেই ছাড় করা হয়েছে ব্যাংক থেকে। দুদক এজন্য অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড আগ্রাবাদ শাখার তৎকালীন শাখা ব্যবস্থাপক বেলায়েত হোসেনকে দায়ী করেছে।
দুদকের অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, ২০১১-১২ সালে ২৮০ কোটি ৭২ লাখ ৩৮ হাজার ৩৭৩ টাকা নেওয়া ঋণের মধ্যে মাত্র ২২ কোটি ১৬ লাখ ২২ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। আর বাকি ২৫৮ কোটি ৫৬ লাখ ১৬ হাজার ৩৭৩ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
পুনঃতপশিলের সুযোগ না নিয়ে গেছেন কারাগারে: ২০২৪ সালের ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতের বিচারক যুগ্ম জেলা জজ মুজাহিদুর রহমানের আদালতে রতনকে হাজির করা হয় নুরজাহান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন রতনকে। ৬ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
রতনের আইনজীবী এবং খেলাপির টাকা ফেরত চেয়ে মামলা করা কয়েকটি ব্যাংকের আইনজীবী আদালতে তাদের বক্তব্য দেন। সবশেষে আদালত রায় হওয়া মামলাগুলোতে রতনের সাজা ভোগের আদেশ দিয়েছিলেন।
আদালতের সেদিনকার ঘটনা নিয়ে অর্থঋণের বেঞ্চ সহকারী রেজাউল করিম গণমাধ্যমকে তখন জানান, বিচারক রতনের উদ্দেশে বলেন, ‘এই আদালতে আপনার প্রতিষ্ঠানের যত মামলা আছে, তাতে ব্যাংকগুলোর দাবি প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। আপনি হয়তো বলবেন সেটা আরও কম। এখানে সাউথইস্ট ব্যাংকের চারটি মামলায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ছয়টি মামলায় ১ হাজার ৫০০ কোটি, রূপালী ব্যাংকের চারটি মামলার মধ্যে তিনটির রায় হয়েছে। এগুলোতে প্রায় ১ হাজার কোটি, জনতা ব্যাংকের দুটি মামলায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকে কোনো মর্টগেজও নেই। এখানে যত মামলা আছে, সবচেয়ে বেশি দায় আপনার। আপনাকে বিচারের আওতায় আনলাম। আমার ওপরও আদালত আছেন। প্রয়োজনে উনারা দেখবেন। আপনি কিছু এনেছেন? কোনো প্ল্যান আছে, কীভাবে টাকা ফেরত দেবেন?’
কারাগারে আয়েশি জীবন: এদিকে গত বছরের জানুয়ারিতে ফের আলোচনায় আসেন রতনের ভাই নুরজাহান গ্রুপের পরিচালক টিপু সুলতান। বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসে কারাগারে তার আয়েশি জীবনের কথা। চিকিৎসকের সঙ্গে লাখ টাকা চুক্তিতে এক বছর কারা হাসপাতালে ভালো সময় কাটান তিনি। তিনি ২০২২ সালের ১ অক্টোবর কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই ভর্তি ছিলেন চট্টগ্রামে ১০০ শয্যার বিভাগীয় কারা হাসপাতালে। অসুস্থ না হয়েও দিনের পর দিন হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় আয়েশি কারাভোগ করেন রোগী সেজে।