কোটা সংস্কার গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন সময়ে গত ১৮ জুলাই রামপুরায় ইটের আঘাতে আহত হন পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) অনুপ বিশ্বাস। এ ঘটনায় প্রায় দুই সপ্তাহ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। কিন্তু আওয়ামী সরকার পতনের দেড় মাস পর তিনি জানতে পারেন গত ১৯ জুলাই খিলগাঁওয়ে আহাদুল ইসলাম নামের একজন আহত হওয়ার ঘটনায় তাকে ১৭ অক্টোবর দায়ের হওয়া হত্যাচেষ্টা মামলায় আসামি করা হয়েছে।
জানা গেছে, এই মামলার ১৭৯ আসামির মধ্যে ৩৬ জনই পুলিশ সদস্য। সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নাকেও শুরুতে এই মামলায় আসামি করা হয়েছিল, তবে সমালোচনার মুখে তার নাম বাদ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) অনুপ বিশ্বাস বলেন, ‘আমি যখন হাসপাতালে ছিলাম তখন আমার এক সহকর্মী আমাকে বলে তাকে এক লাখ টাকা ঘুষ দিতে হবে। টাকা না দিলে তিনি আমাকে হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। এ কারণে ঘুষ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। পরবর্তীতে টাকা দিতে অস্বীকার করায় আমাকে একাধিক হত্যা মামলায় আসামি করার হুমকি দেওয়া হয়।’
এই মামলায় অভিযুক্ত কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার অভিযোগ, ’তাদের কিছু সহকর্মী স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সঙ্গে মিলে একটি চাঁদাবাজ চক্র তৈরি করেছেন। সহজে ফাঁসানো যাবে পুলিশের এমন সদস্যদের টার্গেট করছেন তারা।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, ‘এই চক্রের সঙ্গে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তারা ছাত্র আন্দোলন দমনে সক্রিয় ছিল। এখন তারা আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তাদের অপকর্ম ঢাকতে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। ব্যক্তিগত আক্রোশ ও সুবিধা আদায়ের জন্য কিছু পুলিশ কর্মকর্তা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই সুযোগ নিচ্ছেন। টাকা না দিলে আরও হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ারও হুমকি দিচ্ছেন তারা।’
তারা আরও জানান, ‘গত ১৯ জুলাই রামপুরার ঘটনায় যে পুলিশ সদস্যরা গুলি চালিয়েছিলেন অন্য মামলায় তাদের নাম উঠে এসেছে। তবে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে বাকেরের দায়ের করা মামলায় তাদের নাম নেই। এ থেকে ধারণা করা যায়, বেছে বেছে কিছু মানুষের বিরুদ্ধেই এই মামলা দেওয়া হয়েছে।’
মামলার আসামি তালিকায় নাম থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘পদবি অনুযায়ী টাকা দাবি করা হচ্ছে। পরিদর্শকদের কাছে দুই লাখ, উপপরিদর্শকদের কাছে এক লাখ ও সহকারী উপপরিদর্শকদের কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করছেন ওই চক্রের সদস্যরা।’
এই মামলার আরেক আসামি উপপরিদর্শক রাশেদুর রহমান। মামলার নথি অনুযায়ী, রামপুরায় বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর অভিযোগ রয়েছে রাশেদুরের বিরুদ্ধে। তবে ভাসানটেক থানার নথিপত্রে দেখা যায়, ঘটনার ১১ দিন আগে ৮ জুলাই তাকে রামপুরা থেকে ভাসানটেকে বদলি করা হয়।
এ বিষয়ে রাশেদুর বলেন, ‘ভাসানটেক ও রামপুরার দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। ভাসানটেক থেকে রামপুরায় গুলি চালানো বা একই দিনে একজনের পক্ষে দুই জায়গায় দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়।’
এসআই রাশেদুর রহমানের কাছেও মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য টাকা দাবি করা হয়। তবে তিনি টাকা দিতে অস্বীকার করেন। এ বিষয়ে রাশেদুর বলেন, ‘যে অপরাধ আমি করিনি তার জন্য মামলা থেকে নাম বাদ দিতে কেন টাকা দেব আমি?
এ বিষয়ে মামলার বাদী আহত আহাদুলের বাবা মো. বাকের বলেন, ‘জসিম নামে একজন আইনজীবী এবং আরও কয়েকজন আসামিদের তালিকা তৈরি করেছেন। আমি কেবল এফআইআরে সই করেছি। আমি আমার ছেলের জন্য ন্যায়বিচার চেয়েছিলাম। আমি মামলা করার জন্য তাদের সাহায্য চেয়েছিলাম।’
এসব মামলা বাণিজ্যের বিষয়ে গত ৯ ডিসেম্বর ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের মামলা বাণিজ্যের কারণে এক এসআইকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের মামলা বাণিজ্যে পুলিশও জড়িত। আমার লোক (পুলিশ) যে সব ভালো তা বলব না। আমার কাছে যাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি।’
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সিলেট রেঞ্জ থেকে ডিএমপিতে বদলি হয়ে আসা শাহিন পারভেজকে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় আদাবর থানায় দায়ের করা একটি মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্ব পেয়ে মামলার এক আসামির কাছে টাকা দাবি করেন তিনি। ভুক্তভোগী বিষয়টি ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে লিখিতভাবে জানালে তাকে প্রত্যাহার করা হয়।
সূত্র: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস