ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অনেক ছাত্রীকে আবাসিক হলে সিট না পেয়ে মেসে বা আত্মীয়স্বজনের বাসায় থাকতে হচ্ছে। এই ছাত্রীদের মতে, ক্যাম্পাসের বাইরে থাকায় তাঁরা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নিরাপত্তা নিয়েও থাকে নানা ধরনের শঙ্কা। তার ওপর অতিরিক্ত খরচ তো আছেই, যা তাঁদের শিক্ষাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১২ বছরের শিক্ষার্থী ভর্তির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ছাত্রী ভর্তির হার দিন দিন বেড়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ দুই শিক্ষাবর্ষে ছাত্রের তুলনায় ছাত্রী ভর্তির হার ছিল বেশি। কিন্তু সেই বিবেচনায় তাঁদের জন্য আবাসন সুবিধা বাড়েনি। ফলে বর্তমানে অধ্যয়নরত প্রায় ৫৭ শতাংশ ছাত্রী হলে সিট না পেয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। সেই তুলনায় ছাত্রদের অবস্থা ভালো, তাঁদের ৩৪ শতাংশকে ক্যাম্পাসের বাইরে থাকতে হচ্ছে।
এদিকে ছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত পাঁচটি হলে সিট সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ ছাত্রীকে আবাসন সুবিধা দেওয়ায় গাদাগাদি করে থাকছেন তাঁরা। পাঠাগার, রিডিং রুম, ডাইনিং-ক্যানটিন, রান্নাঘর, শৌচাগার—সবখানে চাপ থাকে সব সময়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এরই মধ্যে প্রথম বর্ষের নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভর্তি সম্পন্ন হলে ছাত্রীদের আবাসন–সংকট আরও তীব্র হবে।
আবাসন–সংকট সমাধানের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করছেন ছাত্রীরা। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল রোববার অবস্থান কর্মসূচি পালন ও উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দেন ছাত্রীরা।
শিক্ষার্থী ভর্তির তুলনামূলক চিত্র
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৩ সালে ছাত্রী ভর্তির হার ছিল প্রায় ৩৮ শতাংশ। সেখানে চলতি বছর সেটা ছিল ৫০ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত বছর ছাত্রী ভর্তির হার ছিল আরও বেশি, ৫১ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত ১২ বছরে যে হারে ছাত্রী ভর্তি বেড়েছে, সেই বিবেচনায় আবাসন বাড়ানো হয়নি। সর্বশেষ ২০১২ সালে ছাত্রীদের আবাসনের জন্য কবি সুফিয়া কামাল হল উদ্বোধন করার পর আর কোনো হল নির্মাণ হয়নি। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে ২০২০ সালে ৪৮ শতাংশ, ২০২২ সালে ৪৭ শতাংশ, ২০২১ সালে ৪৫ শতাংশ ছাত্রী ভর্তি হয়েছেন। ১২ বছরে ছাত্রী ভর্তির হার কখনো ৩৫ শতাংশের নিচে নামেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক হল আছে মোট ১৯টি। এর মধ্যে ছাত্রদের হল ১৩টি, ছাত্রীদের হল ৫টি এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য ১টি হল। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী ৪০ হাজার ২২৬ জন। এর মধ্যে ২১ হাজার ৩৮০ ছাত্রের জন্য ১৩টি হলে সিট রয়েছে ১৩ হাজার ৪৯৪টি। বিপরীতে ১৮ হাজার ৮৪৬ ছাত্রীর জন্য ৫টি হলে সিট রয়েছে ৪ হাজার ৮৪৩। এই হিসাবে প্রতিটি সিটের বিপরীতে ছাত্রের সংখ্যা ১ দশমিক ৫৮। আর প্রতি শয্যার বিপরীতে ছাত্রীসংখ্যা প্রায় ৪ জন। হলের প্রতিটি শয্যায় সাধারণত দুজনের আবাসন ধরে হিসাব করে থাকে কর্তৃপক্ষ।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে ছাত্রী হলগুলোতে থাকছেন ৮ হাজার ১০৭ জন ছাত্রী। আর ছাত্রদের হলগুলোতে থাকছেন ১৪ হাজার ৬৬ জন ছাত্র। দ্বৈত আবাসিকতাসহ নানা উদ্যোগে আবাসিকতা পেয়েছেন প্রায় ৪৩ শতাংশ ছাত্রী। আর ছাত্রদের মধ্যে আবাসিকতা পাওয়ার হার প্রায় ৬৬ শতাংশ।
ছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত শামসুন নাহার হলের প্রাধ্যক্ষ নাসরিন সুলতানা গণমাধ্যমকে বলেন, সর্বশেষ হল নির্মাণের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী ভর্তির হার কম ছিল। এখন সেটি বেড়ে ৫০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। কিন্তু আবাসিক হল বাড়েনি। ফলে বেড়েছে ছাত্রীদের আবাসন–সংকট।
ছাত্রীদের আবাসন–সংকট তীব্র
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের সবচেয়ে বড় আবাসিক হল বেগম রোকেয়া হল। হলটিতে ৫০১টি কক্ষে ২ হাজার ৪টি সিট রয়েছে। আবাসিক ও অনাবাসিক ছাত্রীর সংখ্যা ৭ হাজার ২৭৮ জন। এঁদের মধ্যে বর্তমানে আবাসিক ছাত্রীর সংখ্যা ৩ হাজার ৫৬ জন।
রোকেয়া হলের পর সবচেয়ে বেশি ছাত্রীর আবাসন সুবিধা রয়েছে কবি সুফিয়া কামাল হলে। এই হলটিতে সিট রয়েছে ১ হাজার ৪০টি। আবাসিক ছাত্রী আছেন ১ হাজার ৮৮৩ জন। আর অনাবাসিক ছাত্রীর সংখ্যা ২ হাজার ৮৮২ জন। হলের প্রাধ্যক্ষ সালমা নাসরিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের সংখ্যা বিবেচনায় আবাসন–সংকট প্রকট। এ অবস্থা দূর করতে নতুন ভবন নির্মাণের বিকল্প নেই।
প্রায় একই পরিস্থিতি অন্য তিন ছাত্রী হলেও। শামসুন নাহার হলে ৭০৯ জনের আবাসন সুবিধা রয়েছে। কিন্তু হলটিতে এই মুহূর্তে আছেন ১ হাজার ৪১৮ জন। বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে ৪৫০ সিটের বিপরীতে থাকছেন ৭৫০ ছাত্রী। হল প্রশাসন জানায়, আবাসিক ও অনাবাসিক মিলে হলটিতে প্রায় ৩ হাজার শিক্ষার্থী।
শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ৬৪০টি সিটের বিপরীতে প্রায় ১ হাজার ছাত্রী থাকেন। এই হলের প্রাধ্যক্ষ আলেয়া বেগম গণমাধ্যমকে বলেন, নতুন প্রশাসন বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে। তবে আবাসন–সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য নতুন হল নির্মাণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
হল নির্মাণের উদ্যোগ কম
বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ ২০১৩ সালে ছাত্রদের জন্য ‘বিজয় একাত্তর’ হল উদ্বোধন হয়। আর ছাত্রীদের জন্য সর্বশেষ ২০১২ সালে কবি সুফিয়া কামাল হল উদ্বোধন করা হয়েছে। এরপর নতুন হল হয়নি। যদিও ছাত্রদের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের নতুন ভবন নির্মাণকাজ প্রায় শেষের দিকে। এই হল হলে ছাত্রদের আবাসনের জন্য আরও এক হাজারটি সিট যুক্ত হচ্ছে। সিট বরাদ্দ হলে ছাত্রদের আবাসন–সংকট আরও কমে যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ২০১১ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আবাসনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১১টি ভবন নির্মাণ করেছে। এসব ভবনের ৬৬২ ফ্ল্যাটে ৬৬২ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা–কর্মচারী থাকছেন।
প্রশাসনের উদ্যোগ ও আশ্বাস
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ও প্রশাসন–সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছাত্রীদের হলগুলোতে আবাসন–সংকট কমাতে ‘বাঙ্ক বেড সিস্টেম’ (দোতলা শয্যা) চালু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত অক্টোবরে প্রথম ধাপে বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের বিভিন্ন কক্ষে বাঙ্ক বেড স্থাপন করা হয়।
শামসুন নাহার হল সূত্র জানায়, এই হলের নিচতলায় ৯টি বাঙ্ক বেডে ১৮ জন শিক্ষার্থী থাকেন। দ্বিতীয় তলার ১০টি বাঙ্ক বেডে ২০ জন এবং তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় ১১টি বাঙ্ক বেডে ২২ জন ছাত্রী থাকেন। একটি সূত্র জানায়, শামসুন নাহার হলের মধ্য ভবনের পাঁচতলায় ৬০০ বর্গফুটের একটি কক্ষে আটটি বাঙ্ক বেডে থাকছেন ৩২ জন শিক্ষার্থী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের আবাসন–সংকট মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় নিরুৎসাহিত করতে পারে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের আবাসনের এ পরিস্থিতি মোটেই কাম্য নয়। এমন আবাসন–সংকট থাকলে ছাত্রী ও অভিভাবকেরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বে। মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় বিষয় হলো নিরাপত্তা। তা যদি না থাকে, তবে উচ্চশিক্ষায় মেয়েরা আসা কমিয়ে দেবে।’ সমস্যার সমাধানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আগামী বাজেটেই হল নির্মাণের বন্দোবস্ত রাখা ও হল নির্মাণ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে বাড়ি ভাড়া করে ছাত্রীদের আবাসনের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন, যেখানে ছাত্রীরাই বাসা ভাড়া দেবেন।
সূত্র: প্র.আ