জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘শাহবাগীদের’ দাবিতে যাদের হত্যা করা হয়েছে, খুন করা হয়েছে— তাদেরও আবার বিচারে ফিরিয়ে আনা হবে। শাহবাগীদের বিচার চায় জনগণ। আর যেসব ‘শাহবাগী’ সেদিন বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জ করে পাল্টা সরকার গঠন করেছিল, জনগণ তাদেরও বিচার চায়।
গতকাল ১৬ ডিসেম্বর রাজধানীর পুরানা পল্টন মোড়ে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আয়োজিত সমাবেশ ও বিজয় র্যালি অনুষ্ঠিত হয়। র্যালি-পূর্ব সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আজ থেকে কয়েক বছর আগে (২৮ অক্টোবর ২০০৬ সাল) আজকের দিনেই আল্লাহর কিছু বান্দাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। সেদিন বাংলাদেশ পথ হারিয়েছিল। এই বাংলাদেশের পথ খুঁজে পেতে অনেক রক্ত দিতে হয়েছে। আমাদের বন্ধুদের কী অপরাধ ছিল? তাদের কোনো অপরাধের কথা আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারল না। যারা মেরেছে, এরা মানুষ নয়, এরা পশু। এই মজদুর পরিবারগুলো সেদিন আদালতে গিয়ে বিচার চেয়েছিল, মামলাও দায়ের হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতার গরমে সে মামলা খেয়ে ফেলা হয়েছে। আমরা কথা দিচ্ছি, এই বিচার আবার ফিরিয়ে আনা হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সাক্ষী, এই বিশ্ব সাক্ষী— আমরা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করিনি, করবও না। আমরা প্রিয় দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব কোনো আগ্রাসীদের কাছে কোনো হেজিমোনিস্টদের কাছে বিক্রি করব না, করতেও দেব না। যারা বিক্রি করেছিল আজকে তারা পালিয়ে গিয়ে ওখানেই আশ্রয় নিয়েছে। তারা এই দেশকে নিজের দেশ মনে করত না। কারণ এই দেশে তাদের বাচ্চা-কাচ্চা বসবাস করত না। তাদের বাচ্চাদের নীরবে অন্য দেশে পাঠিয়ে দিয়ে— তারা এই দেশে সন্ত্রাস করে ত্রাসের মাধ্যমে এই দেশকে শোষণ করেছিল।
জামায়াতের আমির বলেন, তারা (আওয়ামী লীগ) মূলত প্রতিশোধ নিতে এসেছিল, আপনারা জানেন কীসের প্রতিশোধ। আমি জিজ্ঞেস করি— সেদিন আপনার পিতাকে কারা হত্যা করেছিল? যারা একাত্তরের রণাঙ্গনে বুক চিতিয়ে যুদ্ধ করেছিল, তাদের হাতে আপনার পিতাকে নিহত হতে হবে কেন? আপনারাই জবাব খোঁজেন। এর জন্য দায়ী কারা? কারা সেদিন ব্যাকফুটে ছিল? কারা সেদিন নব্য সৃষ্টি হওয়া বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছিল। কাদের নেতা বলেছিল— ‘ডানে যেদিকে তাকাই তারা চোর, বামে যেদিক তাকাই তারাও চোর’।
তিনি বলেন, আশ্চর্য লাগে তারা (আওয়ামী লীগ) বাংলাদেশটাকে টুকরা টুকরা করে বিভক্ত করে হিংসার রাজত্ব কায়েম করে পালিয়ে গিয়ে এখনো বাংলাদেশকে তারা স্থির থাকতে দেন না। তারা মাঝেমধ্যেই ফণা তুলে ফুসফাস করবার চেষ্টা করে। যেই জাতি আপনাদের উচিত শিক্ষা দিয়ে তাড়াতে পেরেছে, সেই জাতি আপনাদের ফণাও একদম গুঁড়া করে দিতে পারে। এটা মনে রাখবেন, এই দেশে যোদ্ধা দুই লাখ চার লাখ নয়। এই দেশে যোদ্ধা মিনিমাম ১০ কোটি। এই ১০ কোটি যোদ্ধার ২০ কোটি হাত সদা প্রস্তুত যে কোনো ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার জন্য। আমরা আল্লাহতায়ালার সাহায্য চাই— আমরা যেন অন্যায় এবং অসত্যের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই করতে পারি। প্রিয় দেশবাসী আসুন, আজকে আমরা আরেকবার অঙ্গীকার করি— এই বিজয় দিবসে আমরা অবশ্যই দেশকে ভালোবাসবো, আমরা এই দেশকে কারও তাবেদার বানাতে দেব না এবং কেউ তাবেদারি করতে আসলে তাকেও আমরা ছাড় দেব না।
শফিকুর রহমান বলেন, আমরা জাতি হিসেবে কৃতজ্ঞ জাতি। কিন্তু একটি পরিবার সে কৃতজ্ঞতাকে নষ্ট করে দিয়েছিল। স্বাধীনতার সমস্ত অর্জন ধূলিসাৎ করে সে পরিবারের সম্পত্তিতে পরিণত করা হয়েছিল। বাংলাদেশকে তারা তাদের জমিদারি মনে করে নিয়েছিল। জনগণকে তারা তাদের প্রজা ও ভাড়াটিয়া বানিয়েছিল। আমাদের সন্তানদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছিল। তারা একটি ক্যাডারভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। আজকের এমন একটি বিজয় দিবস বাংলাদেশের মানুষের মাথায় মাথায় লাল সবুজের একেকটি খুঁটি। সবুজ হচ্ছে আমাদের শ্রমিক ও জমিন, আর লাল হচ্ছে শহীদ ভাইদের রক্ত। এই রক্ত দেওয়া কিন্তু শুরু হয়েছিল ৪৭ সাল থেকেই। সে রক্ত দেওয়ার ধারা অব্যাহত রয়েছে ২৪ এর আগস্ট পর্যন্তও।
তিনি বলেন, কিন্তু দুঃখের বিষয়, ’৪৭-এর পরেও জাতি স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারেনি। আবার ’৭১-এর পরেও জাতির স্বাধীনতা হাইজ্যাক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জাতির সামনে এর কোনো জবাব দেওয়া হয়নি। স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া শহীদ জিয়াউর রহমানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সেই পরিবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে জাতিকে শোষণ করেছে, ধোঁকা দিয়েছে, জুলুম করেছে, অধিকার কেড়ে নিয়েছে। জাতিকে দাসে পরিণত করেছিল।
জামায়াতের শীর্ষ এই নেতা বলেন, ’৭২ সালের পর জনগণের হাতে সত্যিকারের স্বাধীনতা তুলে দেওয়ার যে সংগ্রাম হয়েছিল, তা শেষ হয়েছে ’২৪ সালের আগস্টে। ’২৪ সালের এই লড়াইয়েও জনগণকে নিজ দেশের স্বৈরশাসকের কাছে জবাব দিতে হয়েছে। তারা জনগণকেই পাত্তাই দেয়নি। মাটি থেকে, আকাশ থেকে গুলি করে জনগণের বুক ঝাঝরা করে দেওয়া হয়েছে। এই লড়াইয়ের প্রতীক ছিল শহীদ আবু সাঈদ। হাতের মধ্যে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না, কোনো বোমা ছিল না। খালি হাতে শুধু একটি লাঠি নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। সে বলেছিল— ‘বুকের ভেতর তুমুল ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’। সেই ঝড় কি শুধু তার ছিল? না। অধিকার কেড়ে নিয়ে জনগণকে দাসে পরিণত করার ঝড় তার বুকের মধ্যে ছিল, মানুষের ঝড়।
তিনি বলেন, এত রক্ত, এত ত্যাগের পর এটাকে বলা হচ্ছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা। স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখানো আমাদের জাতীয় ও নাগরিক দায়িত্ব। যারা বিদায় নিয়েছে তারাও আমাদের জাতীয় বীর। দেশের বাইরে যারা শহীদ হয়েছে তারাও আমাদের জাতীয় বীর। জাতীয় বীরদের উচ্চ শিখরে রেখে সম্মান জানাতে চাই। তাদের অবদান যেন কোনো গোষ্ঠী, পরিবার, দলের লোলুপ দৃষ্টির সামনে হারিয়ে না যায়। সুতরাং, এই বিজয়, অবদানকে পাহারা দিতে হবে।