Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

'বুড়িগঙ্গা, কাঞ্চন, পোস্তগোলা ব্রিজ ছিল হত্যাকাণ্ড ও গুমের হটস্পট'

 

chardike-ad

গুম হওয়া ব্যক্তিদের হত্যা ও মৃতদেহ গুমের জন্য বুড়িগঙ্গা নদী, কাঞ্চন ব্রিজ ও পোস্তগোলা ব্রিজ উল্লেখযোগ্য স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে। অপহরণ ও গুম বিষয়ক তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

গতকাল (১৪ ডিসেম্বর) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত কমিশন। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের দুটি পন্থায় খালাস করা হয়। হয়, তাদের হত্যা করা হয় অথবা তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দিয়ে বিচারের আওতায় নিয়ে এসে খালাস করা হয়।

তবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে খুব কম মানুষই কোনো অভিযোগ ছাড়াই মুক্তি পেয়েছেন।

অনেক ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, শারীরিক নির্যাতন, জিজ্ঞাসাবাদ এবং আয়নাঘরের মতো ‘বন্দি শিবিরে’ দীর্ঘ সময় ধরে আটক থাকার পর তারা কোনো অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িত ছিলেন না বলে মুক্তি পেয়েছেন। তবে বেশিরভাগের বিরুদ্ধে গুম ও অপহরণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা মামলা দায়ের করতো।

এসব অবৈধ গুম-অপহরণকে ঢাকার জন্য ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হতো।

এছাড়া প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কমিশনের হাতে এমন কিছু রিপোর্ট এসেছে, যেখানে কার্যকর হত্যা পরিকল্পনাগুলোর বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া আছে। সেখানে বলা হয়েছে, যে-সব মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, সেগুলোর ময়নাতদন্তের রিপোর্টে দেখা গেছে, মৃতদের মাথায় গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে ও তাদের দেহগুলো সিমেন্টে ব্যাগের সঙ্গে বেধে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

এটি সামরিক কর্মকর্তাদের ব্যবহৃত সাধারণ পদ্ধতি ছিল। বিশেষ করে যারা র‌্যাবে কর্মরত ছিলেন তারা নিশ্চিত করতেন যে দেহগুলো নদীতে ডুবে থাকবে। আর হত্যা ও দেহ গুম করার স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে বুড়িগঙ্গা নদী, কাঞ্চন ব্রিজ, পোস্তগোলা ব্রিজ ইত্যাদি।

এছাড়া এ ধরনের কার্যক্রম চালানোর জন্য পোস্তগোলা ব্রিজের নিচে একটি নৌকা রাখা ছিল। জানা যায়, নৌকাটি সুন্দরবনে একটি জলদস্যুদের আস্তানায় অভিযান চালিয়ে জব্দ করা হয়। অপহরণ ও গুমের কার্যক্রম চালাতে এ বিশেষ নৌকাটি ব্যবহৃত হতো।

এসব হত্যাকাণ্ডে সক্রিয় অংশীদার ছিলেন র‌্যাবের কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে কমিশন সাক্ষী হিসেবে র‌্যাবের ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের কথা উল্লেখ করেছে। ওই কর্মকর্তা কমিশনকে জানিয়েছেন, তৎকালীন র‌্যাব ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের প্রধান সেসময় একটি ‘ওরিয়েন্টেশন’ সেশন পরিচালনা করেন। সেখানে সেশনের শুরুতেই দুই ব্যক্তিকে কীভাবে ব্রিজের ওপর গুলি করে হত্যা করা হয় তার বর্ণনা দেন তিনি।

র‌্যাব ইন্টেলিজেন্স ইউংয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত আরেক সেনাকর্মকর্তা কমিশনকে এক ভুক্তভোগীর পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি জানান, ওই ভুক্তভোগী নদীতে লাফিয়ে পড়েছিল। তিনি তাকে উদ্ধার করেন। কিন্তু সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়।

এসব ছাড়াও আটককৃতদের আর বিভিন্ন ভাবে হত্যা ও পরে মৃতদেহ গুম করা হতো বলে জানায় কমিশন।

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, এক আটককৃতের মৃতদেহ রেললাইন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এক সেনা কর্মকর্তাকে। যতক্ষণ না পর্যন্ত একটি ট্রেন এসে তাকে গুঁড়িয়ে না দিয়ে যায় ততক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ওই কর্মকর্তাকে।

এমন ঘটনার শিকার এক জীবিত ভুক্তভোগী বলেন, এক পুলিশ কর্মকর্তা তাকে মহাসড়কে নিয়ে গিয়ে চলন্ত গাড়ির সামনে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেই গাড়িটি তাকে আঘাত না করে সরে যায়।

ওই পুলিশ কর্মকর্তা দ্বিতীয়বার আর চেষ্টা করেননি। তাই জানে বেঁচে যান এই ভুক্তভোগী।

কমিশন এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে, হত্যার পদ্ধতিগুলোতে বৈচিত্র্য থাকলেও সবগুলোর উদ্দেশ্য একই। সেটি হলো ভুক্তভোগীদের নির্মূল করা এবং কিছুক্ষেত্রে এমনভাবে নিশ্চিহ্ন করা যাতে তাদের কোনোভাবেই পুনরুদ্ধার বা চিহ্নিত করা না যায়।

তবে এসব কাজ খারাপ কর্মকর্তারাই করতো এ দাবি অস্বীকার করে কমিশন। তাদের মতে এ কার্যক্রমগুলো একদম নিয়মতান্ত্রিকভাবে, বিভিন্ন স্থান ও সংস্থার অংশগ্রহণে সম্মিলিতভাবে এসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এসব অপহরণের অপারেশনগুলোর ব্যাপকতা ও বিস্তার উন্মোচনে আরও বিস্তারিত তদন্তের প্রয়োজন।

২০১৬ সালে সবচেয়ে বেশি গুম বিষয়ক রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়।

অন্তর্বর্তী এ প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছর গত ২৭ আগস্ট কমিশন গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত এক হাজার ৬৭৬টি গুমের অভিযোগ কমিশনে জমা পড়েছে।

কমিটি অনুমান করেছে, দেশে গুমের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়ে যাবে। তবে প্রথম অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় পর্যন্ত কমিশন ৭৫৮টি অভিযোগ পর্যালোচনা করতে পেরেছে।

এই ৭৫৮টি গুমের মধ্যে ১৭ শতাংশ অর্থাৎ ১৩০টি গুম মাত্র ২০১৬ সালেই ঘটেছে এবং ২৭ শতাংশ ভুক্তভোগী এখনও নিখোঁজ।

একইভাবে, বছরের পর বছর গুমের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যা ছিল ২০১৮ সালে ৮৯টি। এরপর ২০১৭ সালে ৮৪টি, ২০১৫ সালে ৭৮টি এবং ২০১৩ সালে ৭৩টি গুম ঘটনা রেকর্ড করা হয়।

 

সূত্র: টিবিএস