দুই পাহাড়ে মাঝে একেঁবেঁকে বয়ে গেছে মাতামুহুরী নদী। ভোরবেলা এই দুই পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ভেসে আসে মেঘ। তার আবছা চাদরে হারিয়ে যায় নিচে থাকা নদী। বেলা গড়ালে মেঘ চিরে বেরিয়ে আসে সূর্যের আভা। ফিতার মতো নদী চিকচিক করে ওঠে রোদে। দেখা দেয় পাহাড়ের আরেক রূপ। এমন শান্ত সমাহিত সৌন্দর্য দেখার জন্য টাওয়ার ও মাচাং ঘর থাকলে তো কথাই নেই। সেখানে বসে নিমেষেই হারিয়ে যাওয়া যায় ঢেউখেলানো পাহাড়ের রাজ্যে।
কেবল আড়াই মাস আগে গড়ে ওঠা পাহাড়ঘেরা মেঘ–পাহাড়ের এই নতুন রাজ্যের নাম ‘সুখিয়া ভ্যালি’। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬০০ ফুটের ওপরে পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা উপজেলায় এর অবস্থান। লামা উপজেলার টিটিএন্ডডিসি এলাকায় মাতামুহুরী নদী আলাদা করেছে দুটি পাহাড়কে। স্থানীয়ভাবে যে দুটি পরিচিত ‘সুইখ্যে-দুইখ্যের’ পাহাড় বা ‘সুখিয়া-দুখিয়া’ পাহাড় নামে। আর সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টিতে (সুখিয়া) অবস্থিত ‘সুখিয়া ভ্যালি’।
নামকরণের কারণ খুঁজে জানা গেল, দুখিয়া পাহাড়ে রয়েছে ছোট একটি ঝরনা। আর ঝরনাকে স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, ‘পাহাড়ের কান্না’। তাই পাহাড়টির নাম দুইখ্যের পাহাড় বা দুখিয়া পাহাড়। অন্যদিকে মেঘের অপরূপ সৌন্দর্য দেখা যায় বলে উঁচু পাহাড়টির নাম সুইখ্যের পাহাড় বা সুখিয়া পাহাড়। মেঘের সৌন্দর্যের টানে আসা রাত্রিযাপনের কথা মাথায় রেখেই এ বছরের শুরুতে এই পাহাড়ে ‘ইকো-ট্যুরিজম’ গড়ে ওঠে।
মূলত বাঁশের তৈরি মাচাং ঘর, কাঠের তৈরি কটেজ ও চারতলা উঁচু ওয়াচ টাওয়ার নিয়ে সাজানো হয়েছে সুখিয়া ভ্যালিকে। যেখান থেকে বিকেলে মাতামুহুরীর আঁকাবাঁকা বয়ে চলা, পাহাড়ের পেছনে সূর্যের অস্ত যাওয়া আর রাতের আকাশে অসংখ্য তারা দেখা যাবে। তবে এখানে পর্যটকেরা আসেন মূলত ভোরের মেঘে ঢাকা রূপ দেখতে।
লামার পর্যটন সম্ভাবনা নিয়ে জানতে চাইলে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘একসময়ের দুর্গম পাহাড়ি লামা বর্তমানে জমজমাট পর্যটন এলাকা। বাণিজ্যিকভাবেও পর্যটন সম্ভাবনা গড়ে উঠছে পাহাড়ে। নিরাপত্তার জন্য লামা-আলিকদমে আমরা ইতিমধ্যে ট্যুরিস্ট পুলিশ দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি।’
যেভাবে যাবেন মেঘের রাজ্যে
সুখিয়া ভ্যালিতে যেতে হলে প্রথমে আসতে হবে কক্সবাজারের চকরিয়া পৌর বাস টার্মিনালে। চট্টগ্রাম নগরের শাহ আমানত সেতু ও চান্দগাঁও থানা এলাকা থেকে প্রতিদিন কক্সবাজারের উদ্দেশে বাস ছেড়ে যায়। এসব বাসে করেই চকরিয়া যাওয়া যায়। শাহ আমানত সেতু থেকে চকরিয়া পৌর বাস টার্মিনালের দূরত্ব প্রায় ৯০ কিলোমিটার, বাসভাড়া জনপ্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে।
কক্সবাজার থেকে আসতে চাইলে বাসে করেই চকরিয়া আসা যাবে। বাসভাড়া ১০০ থেকে ১২০ টাকার আশপাশে। চকরিয়া পৌর বাস টার্মিনাল থেকে লামার উদ্দেশে লোকাল বাস ও চাঁদের গাড়ি (জিপ) ছেড়ে যায়। চাঁদের গাড়ি ও লোকাল বাসে খরচ পড়বে জনপ্রতি ৭০ থেকে ৮০ টাকা। লামা বাসস্ট্যান্ড থেকে জনপ্রতি ২০ টাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে সুখিয়া ভ্যালির প্রবেশমুখে যাওয়া যাবে।
এ ছাড়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে সিএনজিচালিত অটোরিকশা খরচ করে চকরিয়া পৌর বাস টার্মিনাল থেকে সুখিয়া ভ্যালির প্রবেশমুখে যাওয়া যাবে। এরপর প্রায় ৩০ মিনিটের ট্র্যাকিং করে উঠতে হবে সুখিয়া ভ্যালিতে। যাওয়ার সময় লামা বাজারে সেনাবাহিনী চেকপোস্ট রয়েছে। তাই সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি সঙ্গে রাখা ভালো। ট্র্যাকিংয়ের পথটিতে ভালো গ্রিপের জুতা ও মাস্ক সঙ্গে রাখা ভালো।
সুখিয়া ভ্যালিতে দুপুরের রোদ পড়ে যাওয়ার পর উঠলে ভালো। এতে ক্লান্তি কম হবে। বিকেলে সূর্য ডোবার দারুণ রূপ উপভোগ করা যাবে ওয়াচ টাওয়ারে উঠে অথবা ভিউ পয়েন্ট থেকে। মাতামুহুরী নদীর আঁকাবাঁকা পথের পাশে দুখিয়া পাহাড়; এর কোল ঘেঁষে সূর্যাস্তের দৃশ্য, প্রকৃতির অপরূপ এই সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ইচ্ছা করবে মুঠোফোনে তা বন্দী করতে।
মাচাংয়ের বারান্দায় শুয়ে কিংবা ওয়াচ টাওয়ারে দাঁড়িয়ে দেখা যাবে রাতের তারাভরা আকাশ। তবে সুখিয়া ভ্যালির মূল রূপ দেখা যাবে ভোরবেলা। ভোর চারটার দিকেই মাচাংয়ের ভেতর হিমেল বাতাস অনুভূত হয়। চোখ খুললেই দেখা যাবে আশপাশ ঢেকে গেছে মেঘ আর ঘন কুয়াশায়। আরও ভালোভাবে দেখতে চাইলে উঠে যেতে হবে ওয়াচ টাওয়ারে।
কোথায় থাকবেন, কী খাবেন
সুখিয়া ভ্যালিতে ওঠার পথে প্রথমে পড়বে রিভারভিউ ইকো রিসোর্ট। এখানে তিনটি জুমঘর ও দুটি কটেজ রয়েছে, যার একটি ডুপ্লেক্স। কটেজগুলোতে সংযুক্ত শৌচাগার রয়েছে। রিভারভিউ রিসোর্ট থেকে আরও কিছুটা ওপরে সুখিয়া ভ্যালি ইকো রিসোর্ট। এখানে ৬টি জুম ঘর রয়েছে। আকার ভেদে জুম ঘরগুলোতে ৬ থেকে ১৬ জন থাকা যাবে। খরচ পড়বে ২ থেকে ৪ হাজার টাকা। অন্যদিকে কটেজগুলোতে খরচ পড়বে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। একসঙ্গে ৭-৮ জন থাকা যাবে।
পাহাড়ের একেবারে উঁচু পয়েন্টে ওয়াচ টাওয়ারের আশপাশে তাঁবু রয়েছে। এগুলোর এক রাতের ভাড়া ৩০০ থেকে ১ হাজার টাকা। এর পাশেই শৌচাগার ও গোসলখানা। সুখিয়া ভ্যালিতে ২৪ ঘণ্টা পানি ও বিদ্যুতের সুবিধা রয়েছে। চাইলে ওয়াচ টাওয়ারে বসে চায়ের কাপ হাতে রাতের আকাশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে।
খাবারের জন্য সুখিয়া ভ্যালির নিজস্ব প্যাকেজ রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে দুপুরে ভাত, ডাল, মুরগি (ব্রয়লার/পাকিস্তানি), সবজি; সন্ধ্যায় কলা ও বিস্কুট এবং রাতে পাহাড়ের চূড়ায় বারবিকিউ। চাইলে ভাতও খেতে পারবেন। সকালের নাশতায় রয়েছে খিচুড়ি আর ডিমভাজা। জনপ্রতি দুই লিটার পানিসহ চার বেলা খাবারের খরচ ৭৫০ টাকা।
ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি ইজারা নিয়ে সুখিয়া ভ্যালি ইকো-রিসোর্ট করেছেন আটজন উদ্যোক্তা। উদ্যোক্তাদের একজন মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আমরা পর্যটকদের জন্য আরও কিছু জুমঘর ও কটেজের পরিকল্পনা করেছি। খাবারের মান ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। পর্যটকেরা ফেসবুক পেজের মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন।’