দাতা সংস্থার শর্ত থাকা সত্ত্বেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়াবে না। মূলত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের কথা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সফররত প্রতিনিধিদলকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সিস্টেম লস কমানো, দরকষাকষির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কম দামে এলএনজি কেনা এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে লোকসান কমানোর পরিকল্পনা করছে বর্তমান সরকার।
গত মঙ্গলবার জ্বালানি বিভাগ এবং এর পরদিন বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদলের পৃথক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয় বলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। আইএমএফের ডেভেলপমেন্ট মাইক্রো ইকোনমিকস বিভাগের প্রধান ক্রিস পাপেজার্জিয়াস সংস্থাটির ১৩ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন।
জ্বালানি সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা আইএমএফ প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছি, এখন গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যাবে না। তাহলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে দরকষাকষির মাধ্যমে জ্বালানি কেনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ ছাড়া সিস্টেম লস কমানোর ওপর সর্বাধিক জোর দেওয়া হচ্ছে। এ দুটি বিষয় ভালোভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারলে আমাদের খরচ কমে আসবে। এ ছাড়া খাত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেও ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব।
জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, গত মঙ্গলবার জ্বালানি বিভাগের সঙ্গে আইএমএফের বৈঠকে দাতা সংস্থাটির পক্ষ থেকে ট্যারিফ সমন্বয়ের জন্য বলা হয়। চতুর্থ কিস্তি দেওয়ার আগে ঋণ কর্মসূচির শর্ত বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়। বিশেষ করে গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার শর্ত ছিল। কিন্তু জ্বালানি বিভাগের পক্ষ থেকে বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম বাড়ানো সম্ভব নয় বলে জানানো হয়। কারণ, প্রস্তাবিত সমন্বয় মূল্যস্ফীতির চাপকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। বর্তমানে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ২৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জ্বালানি খাতে ১৯ হাজার কোটি এবং বিদ্যুৎ খাতে ৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি রয়েছে। গ্যাসের জন্য প্রতি ঘনমিটারে ৯৮ পয়সা ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। আর আমদানিকৃত এলএনজির দাম বেশি হওয়ায় এ ভর্তুকি বেড়েছে। এলএনজি মিশ্রণের পর সরকার এখন প্রতি ঘনমিটার ৬৫ টাকায় কিনছে।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, আইএমএফকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, এ ভর্তুকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে। এরই মধ্যে সরকার সব কোম্পানির জন্য স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির সুযোগ উন্মুক্ত করেছে। প্রতিযোগিতামূলক দরে এলএনজি কেনা হবে। এলএনজি আমদানির জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা এখন ২২ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৩টিতে। এ ছাড়া জ্বালানি তেল কেনাবেচা করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়ম করপোরেশন (বিপিসি) এখন মুনাফা করছে। এ মুহূর্তে বিপিসির কোনো বকেয়া নেই।
একই কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে আইএমএফের প্রস্তাবও বাস্তবায়ন করছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। জ্বালানি বিভাগের সঙ্গে বৈঠকের পরদিন গত বুধবার আইএমএফ প্রতিনিধিদল বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে। বিদ্যুৎ সচিব বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, বৈঠকে আগামী তিন বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দূর করার কৌশলের অংশ হিসেবে বিদ্যুতের দাম সমন্বয়সহ ৯টি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র পর্যালোচনা করে। এ সময় বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ফারজানা মমতাজ দাম সমন্বয় বা বাড়ানোর বিষয়টি দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করেন। এ সময় বিদ্যুৎ খাতে ১৩ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি কমাতে মূল্য সমন্বয়ের জোর দেয় আইএমএফ। জবাবে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, আইএমএফের এ মূল্যায়ন পুরোনো তথ্য-উপাত্ত নির্ভর। এখন কয়লার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমছে।
দাতা সংস্থাটি আরও জানায়, সরকার ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার পরিকল্পনা করছে। যেগুলোর প্রতি ইউনিট ২৫ টাকা পড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। সরকারের পরিকল্পনা কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চালাতে। যেগুলো ইউনিট প্রতি খরচ হয় ১০ টাকা। বৈঠকে বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে জ্বালানি তেলনির্ভর কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়। এ সময় আইএমএফ বিদ্যুৎ বিভাগকে আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি বিস্তারিত প্রস্তাব জমা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। ঋণের চতুর্থ কিস্তি পেতে হলে এই বিস্তারিত প্রস্তাব খুব দরকার।
এদিকে, পিডিবির বকেয়া দেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৫৯ হাজার ১৪৮ মিলিয়ন টাকা। এর মধ্যে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিপরীতে বকেয়া ৮৮ হাজার ৩২৭ মিলিয়ন টাকা। বৈঠকে আইএমএফকে আরও জানানো হয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বেশকিছু অসম বিদ্যুৎ চুক্তি করা হয়েছে। ওই চুক্তির বেশ কয়েকটি জাতীয় কমিটি পর্যালোচনা করেছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আরও জানান, সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ১০ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা ব্যয় হ্রাস করতে একটি পরিকল্পনা নিয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে ১০ শতাংশ ব্যয় কমে আসবে। মূলত জ্বালানি মিশনকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার অর্থনীতি সংকট মোকাবিলায় ২০২২ সালের জুলাই মাসে আইএমএফের কাছে ঋণ চায়। বাংলাদেশের ঋণ আবেদনের ছয় মাস পর সংস্থাটি ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। এর দুদিন পরই ঋণের প্রথম কিস্তিতে ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তিতে আসে ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। চলতি বছরের জুনে তৃতীয় কিস্তিতে ছাড় হয় ১১৫ কোটি ডলার। তিন কিস্তিতে আইএমএফের কাছ থেকে প্রায় ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিশ্রুত ঋণের মধ্যে আর বাকি আছে ২৩৯ কোটি ডলার, যা ২০২৬ সালের মধ্যে আরও চার কিস্তিতে পাওয়ার কথা।
চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের আগে ঋণের বিপরীতে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছিল, তা পর্যবেক্ষণ করতে আইএমএফের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে আসে। আইএমএফের শর্তের মধ্যে ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা। এই লক্ষ্যে কাজও শুরু করেছিল তৎকালীন আওয়ামী সরকার। এজন্য বিশ্ববাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালু করে। এই পদ্ধতি চালুর পর আওয়ামী সরকারের আমল ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও প্রতি মাসে দাম সমন্বয় করছে। জ্বালানিতে ভর্তুকি প্রথা থেকে বের হতে চলতি বছরের মার্চ থেকে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় শুরু করেছিল বিগত সরকার। তাদের আমলে চারবার দাম সমন্বয় করা হয়েছে। দুবার দাম কমেছে এবং দুবার বেড়েছে। এ ছাড়া গ্যাস বিদ্যুতের দাম সমন্বয় বা বাড়িয়ে ভর্তুকি কমাতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইনও পরিবর্তন করে। আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে নির্বাহী আদেশে কয়েকবার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ায়। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই আইন বাতিল করে।
গ্রাহক পর্যায়ে গত ২০ বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৭ বার। এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম বিদ্যুতের (১০০ ইউনিট পর্যন্ত) দাম বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। পাশাপাশি বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে ১১ শতাংশ। এর মধ্যে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিগত বিএনপি সরকারের আমলে তিনবার, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাতবার, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তিনবার দাম বাড়ানো হয়। এ ছাড়া ২০০৭ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে একবার এবং মহাজোট সরকারের আমলে তিনবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়।
গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি সর্বশেষ নির্বাহী আদেশে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর আগে ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল ২০২৩ সালের ৪ জুন। ২০১৮ সালের শেষভাগে এলএনজি আমদানির সময় থেকে সরকারের খরচ বাড়তে শুরু করে। তখন এ ঘাটতি পূরণ করতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, গত নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। এটি গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার। গত জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল। নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার পাশাপাশি সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বেড়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে উঠেছে।
সূত্র/কালবেলা