দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সাম্প্রতিক কিছু ইস্যুর পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের বর্তমান কাঠামোর বদলে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা যায় কি না, সেই আলোচনা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। জাতীয় ঐক্য ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সাম্প্রতিক বৈঠকেও দু-একটি দলের পক্ষ থেকে জাতীয় সরকারের ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন সভা-সমাবেশেও তারা জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলছেন। তবে এ ব্যাপারে বিএনপির ন্যূনতম কোনো আগ্রহ নেই। এ ধরনের কোনো প্রচেষ্টাকে বিএনপি সমর্থনও করবে না। দলটি মনে করছে, যদি এই ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়, সেটি হবে নির্বাচনকে প্রলম্বিত করার প্রচেষ্টার অংশ। দেশবিরোধী যে কোনো ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় তারা এখন জাতীয় ঐক্যের পাশাপাশি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণায় গুরুত্ব দিচ্ছে। বিএনপি মনে করে, দেশ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় পুরোপুরি প্রবেশ করলে সব ধরনের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাবে। আর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, নির্বাচনে তার দল বিজয়ী হলে বিগত দিনে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া দলগুলো নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জাতীয় সরকার নিয়ে আগেও কারও কারও ব্যক্তিগত মতামত ছিল। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা যে দলগুলোকে আহ্বান করেছিলেন, সেখানে অনেকগুলো দলের মধ্যে একটি দল এ রকম পরামর্শ দিয়েছে। আলোচনায় আরও অনেক পরামর্শও এসেছে। একেকজনের একেক মতামত থাকতেই পারে। সবাই জাতীয় ঐক্যে গুরুত্ব দিয়েছে। তবে জাতীয় ঐক্য করতে হলে জাতীয় সরকার হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। আমরা জাতীয় ঐক্য সৃষ্টিতে জোর দিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার যদি মনে করে, ঐক্যবদ্ধভাবে দেশবিরোধী সব ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবিলা করতে হবে, তাহলে তারা জাতীয় ঐক্যের প্রস্তাব করবেন। কী পদ্ধতিতে সেই জাতীয় ঐক্য হবে, সে ব্যাপারে আমরা সরকারকে দায়িত্ব দিয়েছি।’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। এরপর সংবিধানকে অনুসরণ করেই ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। তবে দীর্ঘ চার মাসেও সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সিন্ডিকেট বহাল থাকায় নিত্যপণ্যের দাম এখনো সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসেনি। প্রশাসনে কিছু রদবদল করা হলেও ঘুরেফিরে আওয়ামী আশীর্বাদপুষ্টরাই এখনো রয়ে গেছে। তারাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন মহলে এই সরকারকে একটি দুর্বল সরকার হিসেবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করছেন অনেকে।
তাদের অভিমত, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কেউ অন্তর্বর্তী সরকারে না থাকায় পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হচ্ছে না। সরকারও পুরোপুরি আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে, যারা আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট। দেশ ও সরকারকে অস্থিতিশীল করতে দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে বলেও অভিযোগ তাদের। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার চার মাস পর হঠাৎ করেই জাতীয় সরকারের আলোচনা সামনে এসেছে। এই আলোচনার পক্ষে যারা আছেন তাদের বক্তব্য হচ্ছে, শুরুতে এ ধরনের সরকার বা একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করা গেলে সব ধরনের চক্রান্ত মোকাবিলা করা সহজ হতো।
বিদ্যমান সংকট উত্তরণে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা যায় কি না, রাজনৈতিক অঙ্গনের সাম্প্রতিক আলোচনায় উঠে এসেছে সেটি। তা ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং সরকারের দায়িত্বশীল বিভিন্নজনের পক্ষ থেকে নানা সময় বলা হচ্ছে, ‘আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন’। সেটাকে নিশ্চিত করার জন্যও জাতীয় সরকারের কথা বলা হচ্ছে বলে মনে করেন অনেকে। কেননা, বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম শেষে দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। তারা মনে করেন, সব সংস্কার করে নির্বাচন দিতে গেলে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে নির্বাচন প্রলম্বিত হবে। যেটা বর্তমান বাস্তবতায় সম্ভব নয়। তা ছাড়া গত ১৭ বছর ধরে ভোটাধিকার বঞ্চিত জনগণ এখন ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে আছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের পরপরই একটা জাতীয় সরকার গঠনের কথা কোনো কোনো তরফ থেকে বলা হলেও বিএনপি তাতে রাজি হয়নি। দলটি এখনো একই অবস্থানে রয়েছে। এমন সরকার গঠনের কোনো প্রচেষ্টায় বিএনপি সমর্থন দেবে না এবং এমন কোনো উদ্যোগও তারা চায় না। অবশ্য নতুন করে জাতীয় সরকার নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে আলোচনা শুরু হয়েছে, সেটা খুব যে একটা পরিপক্ক পর্যায়ে গেছে, এমনটা নয়।
বিএনপির অবস্থান হচ্ছে, তারা একটা যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন চায়। তাই রোডম্যাপের জন্য তারা বেশ কয়েক মাস ধরে বলে আসছে। তাদের বক্তব্য, সংস্কার এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া সমান্তরালে চলতে পারে। এমনটা হলে দেশবিরোধী সব ধরনের চক্রান্ত ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাবে।
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের দুজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচন প্রলম্বিত হয়, এমন কোনো উদ্যোগে বিএনপি যাবে না। তারা সরকারকে এমন অবস্থানে দেখতে চায়, যেখানে তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হবে নির্বাচন। তাই সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত, নির্বাচনমুখী সংস্কার তথা নির্বাচন কমিশন (ইসি), বিচার বিভাগ এবং প্রশাসন—এই তিনটির প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
সূত্র/ কালবেলা