ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে একাধিক ব্যাংক দখল করে রীতিমতো অর্থ লুট করা হয়। এর বাইরে অন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে নিয়মের বাইরে নামে-বেনামে ঋণের নামে অর্থ বের করে নেওয়া হয়। ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক বরং এ কাজে সহায়তা করেছে। অনেক ক্ষেত্রে আড়াল করে রেখেছে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ। এসব ঋণের বিপরীতে নেই পর্যাপ্ত জামানতও।
সরকার বদলের পর এখন ব্যাংক ঋণের প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসছে। জানা যাচ্ছে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মালিকানা বদল হওয়া ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো, এস আলম, বসুন্ধরা গ্রুপসহ আরও অনেকের ঋণও খেলাপি হয়ে পড়েছে। ফলে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এতে সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
আলোচ্য সময়ে সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ যত বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ। যেমন সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা, আর বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪৯ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।
ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক বরং এ কাজে সহায়তা করেছে। অনেক ক্ষেত্রে আড়াল করে রেখেছে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ। এসব ঋণের বিপরীতে নেই পর্যাপ্ত জামানতও।
ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিন এসব খেলাপি ঋণ লুকানো ছিল, যে ক্ষতি হয়েছে, তা গোপন করা ছিল। ২০১৯ সালে আজব এক নীতিমালা করে খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষায়ও প্রকৃত চিত্র বের হয়নি। আন্তর্জাতিক নীতি মেনে চললে প্রকৃত চিত্র বের হয়ে আসবে।’
সেলিম আর এফ হোসেন আরও বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দুর্বল ব্যাংক নিরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ব্যাংকের নিজ উদ্যোগে এমন নিরীক্ষা করা উচিত। এতে প্রকৃত চিত্র বের হয়ে আসবে। এরপর পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যবস্থা ও উদ্যোগ নিতে হবে।’
কত বাড়ল খেলাপি ঋণ
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। গত জুন শেষে যা বেড়ে হয় ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। তখন দেশের ব্যাংকগুলো থেকে বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশই খেলাপি ছিল। গত সেপ্টেম্বর শেষে সেই খেলাপি ঋণ বেড়ে এখন প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা হয়ে গেছে। অথচ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা বলছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ সহযোগীদের ১ হাজার ৬৭০ কোটি ডলার বা ২ লাখ কোটি টাকা লুটের যে কথা বলেছেন, তার সবই খেলাপিযোগ্য। ফলে সামনে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন রাখতে ও কাগজে-কলমে কমিয়ে দেখাতে নানা কৌশল অবলম্বন করত।
নতুন সরকার এসে প্রকৃত তথ্য দেখানোর নির্দেশ দেওয়ার পর খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য আসতে শুরু করেছে।
বিগত আওয়ামী লীগ আমলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)
বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলারের যে ঋণ দিয়েছে, তার একটি শর্ত হচ্ছে ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। তবে একেবারে উল্টোটিই ঘটেছে।
বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ গত মার্চে ছিল ৮৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, যা জুনে বেড়ে হয় ৯৯ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা। এতে বড় ভূমিকা রেখেছে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলো।
কার বেশি খেলাপি ঋণ
আলোচ্য তিন মাসে খেলাপি ঋণ বাড়াতে সরকারি ব্যাংকের চেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। গত মার্চে সরকারি খাতের সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৮৪ হাজার ২২১ কোটি টাকা, যা জুনে বেড়ে হয় ১ লাখ ২ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে যা আরও বেড়ে হয় ১ লাখ ২৬ হাজার ১১১ কোটি টাকা। আর এই খেলাপি ঋণের অর্ধেকই জনতা ব্যাংকের। ব্যাংকটিতে বেক্সিমকো গ্রুপ, অ্যাননটেক্স গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এবং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম উভয়েই ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী। সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার এখন ৪০ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
এদিকে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ গত মার্চে ছিল ৮৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, যা জুনে বেড়ে হয় ৯৯ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা। এতে বড় ভূমিকা রেখেছে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে জুনে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৭ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বর শেষে বেড়ে হয়েছে ১৭ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি, ন্যাশনাল, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেশ বেড়েছে। বসুন্ধরা গ্রুপের ঋণও খেলাপি হয়ে পড়েছে। বেসরকারি খাতের ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার এখন ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণ প্রসঙ্গে এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এস আলম গ্রুপের ৭ ব্যাংকে যে আমানত ছিল, তার বেশির ভাগ নামে-বেনামে বের করে নিয়েছে গ্রুপটি। এসব ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ছে। আবার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ অন্য ব্যবসা করে এমন অনেক ব্যবসায়ী পালিয়ে গেছে। তাদের ঋণও খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।’ আনিস এ খান আরও বলেন, ‘যারা ইচ্ছা করে ঋণ পরিশোধ করছে না, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যা অন্য গ্রাহকদের জন্য ভালো বার্তা দেবে।’
যেভাবে লুকানো হতো
রাষ্ট্রীয়ভাবে গত ১৫ বছরে ঋণখেলাপি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের একের পর এক ছাড় দেওয়া হয়েছে। একদিকে বিশেষ বিশেষ গ্রাহককে বেশি ঋণ দিতে আইন শিথিল করা হয়েছে, অন্যদিকে আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে খেলাপিদের ঋণ দিতে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে তৎকালীন সরকার খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করে। সালমান এফ রহমানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দেওয়া হয়। ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রেও দেওয়া হয় বিশেষ ছাড়। ২০১৯ সালে ২ শতাংশ অর্থ দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়।
এরপর কোভিড মহামারি শুরু হলে সব ধরনের গ্রাহককে ঋণ পরিশোধ না করার সুবিধা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে কিছু ভালো ঋণগ্রহীতাও ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন। সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যোগ দিয়ে ঋণখেলাপিদের ঢালাও ছাড় দিয়ে নতুন নীতিমালা জারি করেন। আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়। খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে আগে জমা দিতে হতো ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ। এর পাশাপাশি খেলাপি ঋণ পাঁচ থেকে আট বছরে পরিশোধের সুযোগ রাখা হয়। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো। এর ফলে খেলাপি হয়ে পড়া ঋণ আড়াল করার সুযোগ আরও বেড়ে যায়। পাশাপাশি প্রভাবশালীদের মালিকানায় থাকা ব্যাংক ও তাদের ঋণ আদায় না হলেও দীর্ঘদিন খেলাপি দেখানো হতো না, যা এখন খেলাপির খাতায় যুক্ত হচ্ছে।