Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

রংপুরে আমনের বাম্পার ফলন

 

chardike-ad

শস্য ভান্ডার বলে পরিচিত রংপুরে চলতি মৌসুমে আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে গেছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার জেলার চাহিদা মিটিয়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টনেরও বেশি আমন ধানের চাল উদ্বৃত্ত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করছেন জেলার কৃষি বিশেষজ্ঞরা। উদ্বৃত্ত চাল অন্য জেলার চালের চাহিদা মেটাতেও সক্ষম হবে।

অন্যদিকে মাঠ ঘুরে কৃষক ও বর্গা চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চড়া সুদে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সার ও কীটনাশক ও সেচসহ বিঘা প্রতি অতিরিক্ত টাকা খরচ হয়েছে। ফলে তারা খুব একটা লাভবান হতে পারবেন না।

অন্যদিকে, খাদ্য বিভাগ কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান না কিনে বড় বড় ব্যবসায়ীর কাছে চাল কেনার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এতে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য এবারও পাবেন না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন। অথচ কম মূল্যে ধান কিনে ব্যবসায়ীরা চাল বানিয়ে সরকারি খাদ্য গুদামে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা নেবেন এবারও।

কৃষকদের অভিযোগ, তারা ধান বিক্রি করতে গেলে খাদ্য কর্মকর্তারা নানান অজুহাত দেখিয়ে অনীহা প্রকাশ করলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। শুধু তাই নয়, প্রতিবারই খাদ্য বিভাগ ধান চাল সংগ্রহ অভিযানের নামে গল্প বানায়, কিন্তু প্রকৃত কৃষক আর বর্গা চাষিদের কাছ থেকে ধান কেনে না।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রংপুরে চলতি আমন মৌসুমে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল এক লাখ ৬৬ হাজার ৭২৩ হেক্টর জমি। সেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছাপিয়ে ধান চাষ হয়েছে এক লাখ ৬৬ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমি। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৪৪ মেট্রিক টন।

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, ইতিমধ্যে ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) পর্যন্ত জেলার ৮ উপজেলায় শতকরা ৩০ ভাগের বেশি জমিতে ধান কাটা ও মাড়াই শেষ হয়েছে। হেক্টর প্রতি তিন টনেরও বেশি চাল উৎপাদিত হয়েছে।

কৃষি বিভাগ আরও জানিয়েছে, এবার আবহাওয়া অনুকূলে ছিল, বৃষ্টি হয়েছে প্রচুর। ফলে কৃষকদের জমিতে এবার খুব বেশি সেচ দিতে হয়নি। ফলে যথাসময়ে জমিতে বৃষ্টির পানি দিয়ে চারা রোপণ এবং অপেক্ষাকৃত কম সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করায় আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। রংপুর জেলার মানুষের চালের চাহিদা হচ্ছে প্রায় আড়াই লাখ টন। সেখানে চাল উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টনের কাছাকাছি।

ফলে জেলার এলাকার চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্য জেলার প্রায় সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।

সরেজমিন রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর, পালিচড়া, পাগলাপীরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দিগন্ত জোড়া মাঠে সোনালি ধানে ভরে আছে। প্রতিটি গাছে থোকায় থোকায় ধান।

পালিচড়া গ্রামের বর্গা চাষি সালাম, মঞ্জুর হোসেনসহ অনেকেই জানালেন, এবার ইউরিয়া সার পাওয়া গেলেও ডিএপিসহ অন্য সারের দাম অনেক বেশি ছিল। সেই সঙ্গে জমি তৈরি ও চারা রোপণের সময় জমিতে সেচ দিতে হয়েছে। সেই সঙ্গে ক্ষেতমজুরদের মজুরি এখন ৫০০-৬০০ টাকা দিতে হয়- তার ওপর দুপুরে এক বেলা ভাত খাওয়াতে হয়- ফলে ধান উৎপাদনে খরচ এখন অনেক বেশি লাগে।

অপরদিকে এখন ধান কাটা ও মাড়াই করতে ক্ষেতমজুর পাওয়া যায় না। এরপর ধান কাটার পর মাড়াই করা ধান শুকানোসহ অনেক টাকা ব্যয় হয়- সে কারণে ধান চাষ করে যে টাকা খরচ হয় সেটাই ওঠে না।

পাগালাপীর এলাকার কৃষক মমতাজ উদ্দিন, একবার মিয়া জানান, তারা দাদন ব্যবসায়ী ও এনজিওসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ধান চাষ করেছেন। এখন বিক্রি করতে হচ্ছে অর্ধেক দামে। এক মণ ধান কমপক্ষে ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা হলে তারা পোষাতে পারে। কিন্তু হাট বাজারে এখন প্রতি মণ ধান ১২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর এলাকার প্রান্তিক কৃষক সোলায়মান আলী, আফছারুল ইসলামসহ অনেকেই জানান, খাদ্য বিভাগ চাল কেনার দাম নির্ধারণ করেছে ৪২ টাকা কেজি। আর ধান কিনবে ৩০ টাকা কেজি দরে। কিন্তু তারা কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান না কিনে মিল ও চাতালসহ বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেনেন। ফলে ওই সব ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে ধান কেনেন নামমাত্র মূল্যে। বাধ্য হয়ে কৃষকরা কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এর ফলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তারা। আর খাদ্য গুদামে ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষক ও বর্গা চাষিরা ধান নিয়ে গেলে কিনতে চান না। তারা মাঠ পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মাধ্যমে আসতে বলেন।

তারা জানান, কিন্তু উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তারা তালিকা করার সময় বর্গা চাষিদের নাম তালিকাভুক্ত করে না। তারা জমির মালিককে খোঁজেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জমির মালিক নয়, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক আর বর্গা চাষিরাই মূলত ধান চাষ করেন। ফলে তাদের নাম তালিকাতেই আসে না- যার কারণে তারা ন্যায্য মূল্য কখনও পান না।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  জানান, খাদ্য বিভাগ ধান কাটা ও মাড়াইয়ের পর পরই যদি কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনেন তাহলে কৃষকরা একটু হলেও লাভবান হতো। তারা ধান কেনার ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত সরাসরি কিনছে না। ফলে যারা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি তারা দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে নেওয়া ঋণের টাকা পরিশোধসহ বিভিন্ন খরচ মেটাতে ধান কাটার পরই ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন। সে কারণে এ সময় বড় বড় ব্যবসায়ীরা কম দামে ধান কেনার আশায় ধান কেনা থেকে বিরত থাকে। ফলে তারা উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য পায় না।

এ বিষয়ে রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন জানিয়েছেন, এবার অন্য জেলার চেয়ে রংপুরে আমন ধানের ফলন অসম্ভব ভালো হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। জেলার খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন চাল অন্য জেলার চাহিদা মেটাবে।

তিনি আরও বলেন, ধান কাটা ও মাড়াইয়ের পরপরই কৃষকরা জমিতে আলুর চারা রোপণ করবেন। অনেকে বোরো ধানের চারা রোপণ করার জন্য জমি তৈরি করবেন। ফলে খাদ্য রংপুরে সংকট হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।