ভোটের আগে ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু–কাশ্মীর শান্তি ফিরিয়ে আনার দাবিতে যারা মুখর ছিল, ভারতের সেই শাসক দল বিজেপির কপালের রেখা আবার গাঢ় হতে শুরু করেছে। ভোটের পর নতুন সরকার গঠনের সময় থেকে নতুন করে শুরু হয়েছে জঙ্গি তৎপরতা। হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে চলেছে নতুন করে। তাতে প্রাণহানি ঘটছে। রক্ত ঝরছে। হঠাৎ কেন এই চোরাগোপ্তা আক্রমণ বৃদ্ধি, তা নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক বিতর্ক। প্রশ্ন উঠেছে, অতি দ্রুত জম্মু–কাশ্মীর কি ফিরে যাচ্ছে সেই আগের অনিশ্চিত দিনগুলোয়?
দীর্ঘ ১০ বছর পর ভূস্বর্গে বিধানসভার ভোট হয়েছে প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনায়। তিন দফার ভোট পর্ব শেষ হয় ১ অক্টোবর। ভোটের আগে এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হয়ে উঠেছিল শান্তির নিকেতন। ৪ অক্টোবর গণনা শেষে জয়ী হয় ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি)। ১৬ অক্টোবর আরও একবার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ওমর আবদুল্লাহ্। তার পর থেকে গত রোববার পর্যন্ত ১৯ দিনে ১০টি সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে। মারা গেছেন ও জখম হয়েছেন একাধিক সেনাসদস্য, সাধারণ মানুষ, পরিচিত চিকিৎসক, পরিযায়ী শ্রমিক ও জঙ্গি। কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন যে শ্রীনগরকে জঙ্গিমুক্ত বলে দাবি করেছিল, সেই শ্রীনগরের ব্যস্ততম এলাকা ট্যুরিস্ট রিসেপশন সেন্টারের সামনে গত রোববার গ্রেনেড হামলায় ১০ জন আহত হন। আচমকাই ফিরে এসেছে ভয়ের বাতাবরণ।
সেই সঙ্গে সন্দেহও। রাজনৈতিক স্তরে প্রশ্ন উঠে গেছে, নতুন নির্বাচিত সরকারকে নড়বড়ে করা, অস্থিতিশীল করে তোলা আচমকা এই সব সন্ত্রাসী হানার উদ্দেশ্য কি না। সে জন্য চক্রান্ত শুরু হয়েছে কি না।
সন্দেহ শুধু সন্দেহের স্তরেই থাকেনি, প্রকাশ্যে সেই সন্দেহ প্রকাশও করে ফেলেছেন ওমরের পিতা এনসির সভাপতি ফারুক আবদুল্লাহ। গত শনিবার শ্রীনগর ও অনন্তনাগ জেলায় দুটি পৃথক ঘটনায় লস্কর–এ–তইবার এক কমান্ডারের মৃত্যু ও চারজন নিরাপত্তারক্ষীর আহত হওয়ার ঘটনার পর ফারুক আবদুল্লাহ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গিয়ানা বেড়ে গেল। কেন? কেন পরপর এত ঘটনা ঘটছে? অবশ্যই এর তদন্ত হওয়া দরকার। তিনি বলেন, ‘আমার সন্দেহ হচ্ছে, যারা এই সরকারকে থিতু হতে দিতে চায় না, তারা এই সব কাণ্ড হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা ধরা পড়লে জানা যেত কারা এসব করাচ্ছে। কোনো এজেন্সি ওমর আবদুল্লাহ সরকারকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে কি না। এর তদন্ত করে দেখা দরকার।’
ফারুক আবদুল্লাহ কারও নাম করেননি। কিন্তু বিজেপি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে। দলের জম্মু–কাশ্মীর সভাপতি রবীন্দ্র রায়না বলেন, ‘তদন্তের কী আছে? সবাই জানে কারা এই সন্ত্রাসবাদের হোতা। পাকিস্তান এই অপকর্ম করে আসছে। তাদের বাধা দিচ্ছে আমাদের সেনা ও পুলিশ। প্রত্যেকের উচিত সেনা, পুলিশ ও অন্য নিরাপত্তারক্ষীদের সমর্থন করা।’
বিজেপির আরেক নেতা কবীন্দ্র গুপ্ত সরাসরি ফারুকের সমালোচনা করে বলেন, তাঁর মতো মানুষের এমন সন্দেহ করা উচিত নয়। এমন কথাও বলা উচিত নয়। ওমরের সরকারকে কেউ অপদস্থ বা দুর্বল করতে চাইছে না। সীমান্তপার থেকেই এই সন্ত্রাস চালানো হচ্ছে, সবার তা জানা।
ফারুক অবশ্য একা নন, তাঁর নির্বাচনী শরিক ও ইন্ডিয়া জোটের সদস্য কংগ্রেসও একই ধরনের সন্দেহ প্রকাশ করেছে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তারিক হামিদ কাররাও ফারুকের সুরে সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘যা ঘটছে তা খুবই উদ্বেগের বিষয়। ঘটনা ঘটার সময়টা সন্দেহ জাগাচ্ছে। নির্বাচন খুবই শান্তি কেটেছে। নির্বিঘ্নে সবাই প্রচার করেছে। কোথাও কিছু ঘটেনি। অথচ ভোটের পর সরকার গঠনের পর থেকেই শুরু হয়ে গেল তাণ্ডব ? আশ্চর্য এটাই!’
জম্মু–কাশ্মীরের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এবারের ভোটের প্রধান বিষয় ছিল দ্রুত রাজ্যের মর্যাদা ফেরানো। তাদের প্রত্যাশা ছিল ভোটের আগেই সেই প্রতিশ্রুতি কেন্দ্রীয় সরকার পালন করবে। কিন্তু তা হয়নি। সরকার গঠনের পর মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে রাজ্যের মর্যাদা ফেরানো নিয়ে এক সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। দিল্লি এসে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করে ওমর আবদুল্লাহ্ও ওই দাবি জানিয়ে গেছেন। যদিও কবে সেই দাবি মানা হবে, কবে কেন্দ্রীয় সরকার তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে এখনো কিছু জানায়নি। সরকারি ভাষ্য, উপযুক্ত সময়েই তা করা হবে। সেই সময় কবে আসবে অজানা।
তবে জম্মু–কাশ্মীরের ভারপ্রাপ্ত বিজেপির নেতা রাম মাধব ভোটের পর এক সাক্ষাৎকারে এই বিষয়ে কিছুটা অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সংসদেই সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সেই প্রতিশ্রুতি অবশ্যই পালিত হবে। তবে দেখতে হবে জম্মু–কাশ্মীরে যেন সেই সব ভয়ংকর দিন আবার ফিরে না আসে।
ওই মন্তব্য এবং শান্তিপূর্ণ ভোটের পর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের আবার অশান্ত হয়ে ওঠার মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কি? সেটাই কি রাজ্যের রাজনৈতিক নেতাদের মনে সন্দেহ সৃষ্টির কারণ? তাই চক্রান্ত তত্ত্বের অবতারণা? এত দিন মোটামুটি শান্ত থাকার পর হুট করে সন্ত্রাসী হানা বেড়ে যাওয়ার নেপথ্য কারণ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের দিক থেকে এখনো কোনা ব্যাখ্যা অবশ্য আসেনি।
জঙ্গি হানা নিয়ে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের এই আবহে সোমবার থেকে শুরু হলো বিধানসভার প্রথম অধিবেশন। প্রথম কাজ স্পিকার নির্বাচন। তারপর উপরাজ্যপালের ভাষণ। দেখার, সেই ভাষণে রাজ্যের মর্যাদা ফেরানো নিয়ে তিনি কোনো আশ্বাস দিতে পারেন কি না। আরও দেখার, রাজ্য দ্বিখণ্ডিকরণ ও ৩৭০ অনুচ্ছেদসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক মর্যাদা খারিজের বিরুদ্ধে বিধানসভায় কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় কি না।