দক্ষিণ কোরিয়া উত্তর-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ যা কোরীয় উপদ্বীপের দক্ষিণ অংশটি নিয়ে গঠিত। সিউল হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার বৃহত্তম শহর ও রাজধানী। এটি বিশ্বের শীর্ষ ১০টি ধনী শহরের তালিকায় থাকা একটি শহর।
কোরীয় উপদ্বীপের দক্ষিণ অংশে অবস্থিত দক্ষিণ কোরিয়ায় ইসলাম একটি সংখ্যালঘু ধর্ম। সেখানকার অধিকাংশ মুসলিম সিউলে বসবাস করে। তবে সারা দেশে মসজিদ রয়েছে। কোরিয়া মুসলিম ফেডারেশনের মতে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রায় ২ লক্ষ মুসলমান বাস করে এবং তাদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বিদেশী এবং মোট মুসলিম জনসংখ্যার ৪০% সিউলে বাস করে।
আমেরিকার পিউ রিসার্চ সেন্টারের অনুসন্ধান মতে, দক্ষিণ কোরিয়ার সর্বমোট জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ নাস্তিক বা কোনো ধর্মে বিশ্বাসী না হলেও সেখানে মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধিই পাচ্ছে।
চলুন আজ কোরিয়ায় মুসলিমদের সংখ্যা কেন বাড়ছে তার একটি ধারণা নিয়ে আসা যাক-
ইসলামী সংস্কৃতি বনাম কোরিয়ান সংস্কৃতি
মুনা হিউনমিন বেই দক্ষিণ কোরিয়ার একজন সাড়া জাগানো আলোচিত নারী। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ কোরিয়ায় তাঁর জন্ম। বর্তমানে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসবাস করছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার কিউন স্কুল অব আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন থেকে ‘সিনোগ্রাফি অ্যান্ড স্টেজ ডিজাইন’-এর ওপর দক্ষতা অর্জন করেন। ২০০৯ সালে মুনা ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম অনুশীলনের ক্ষেত্রে কোরিয়ানদের মানসিক দূরত্ব কমিয়ে আনাই হলো তাঁর মূল উদ্দেশ্য।
মুনা হিউনমিন বেই কোনো এক প্রসঙ্গে ‘গ্লোবাল ফান্ড ফর উইমেন’কে বলেন, ‘বহু কোরিয়ান মনে করেন যে ইসলাম হলো মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতিনির্ভর একটি ধর্ম! অতএব, তাদের দৃষ্টিতে ইসলাম কোরিয়ানদের ধর্ম হতে পারে না এবং এই ধর্ম কোরিয়ান সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না! কিন্তু কোরিয়ার বিগত রাজশাসন জসুনের সময়ে এমন প্রচুর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ছিল, যেগুলো ইসলামী শিক্ষার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। একজন কোরিয়ান মেয়ে হিসেবে আমি বিশেষভাবে জসুন নারীদের একটি সংস্কৃতি দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলাম, সেটি ‘জাং-ওট’ নামে পরিচিত। নারীরা ঘর থেকে বের হওয়ার সময় নিজেদের পুরো শরীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে নিত, এমনকি কখনো মুখমণ্ডলও ঢাকা থাকত। প্রকৃতপক্ষে এটা ইসলামের বিধান ‘হিজাব’-এর বাস্তবিক একটি প্রতিচ্ছবি। তাই মুসলমান ও কোরিয়ানের মধ্যে বহু ক্ষেত্রে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত মিল রয়েছে। অতএব, একজন কোরিয়ান থেকে মুসলমানও হতে পারে!’
ইসলাম ধর্মের প্রতি দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের সফট মানসিকতা থাকার ফলে, দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছে দ্বিতীয় ইসলামিক কনফারেন্স। এতে যোগ দেন বাংলাদেশের দুই ইসলামিক স্কলার শায়খ আহমাদুল্লাহ ও মিজানুর রহমান আজহারী।
বাংলাদেশের দুই জনপ্রিয় ইসলামিক স্কলারদের এক নজর দেখতে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন কয়েক হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি।
কোরিয়াতে ইসলামচর্চায় সুযোগ-সুবিধা
বিভিন্ন অনুসন্ধানী রিপোর্ট থেকে জানা যায় কোরীয়দের মধ্যে মুসলমানরা মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.৪%।
তবে স্থায়ী ও প্রবাসী মুসলমানরা দক্ষিণ কোরিয়ায় নিজেদের ঈমান ও আমল সংরক্ষণ তথা ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সচেতন। এক তথ্য মতে, রাজধানী সিউল, বুসান প্রভৃতি অঞ্চলে বর্তমানে ১৫টি মসজিদ এবং ৬০টি নামাজঘর রয়েছে।
১৯৬৯ সালে কোরিয়ান সরকার প্রদত্ত জমিতে গড়ে ওঠে সিউল কেন্দ্রীয় মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার। সিউল সেন্ট্রাল মসজিদ দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম মসজিদ, যা বিশ্বের অনন্য সুন্দর মসজিদ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
তা ছাড়া মুসলমানদের জন্য বিশেষভাবে হালাল গোশত ও হালাল ফুডের ব্যবস্থা রয়েছে। এক ইতাওয়ান শহরেই প্রচুর হালাল রেস্টুরেন্ট ও হালাল গোশতের দোকান গড়ে উঠেছে। আর দ্বিন প্রচারের কর্মে তাবলিগ জামাতের কর্মতৎপরতা বেশ লক্ষণীয় ও প্রশংসনীয়।
দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০০৪ সাল থেকে প্রতি বছর রমজান মাসে ইফতারের আয়োজন করে আসছে।
সিউল সেন্ট্রাল মসজিদে প্রতিবছর তাবলিগের ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখান থেকে সারা দেশে, এমনকি বাইরের দেশেও জামাত পাঠানো হয়। জামাতের কাজে তরুণদের সাগ্রহ অংশগ্রহণ বড়ই আশাজাগানিয়া। অন্যদিকে সেখানে দ্বিনি কর্মতৎপরতা পরিচালনার নিমিত্ত কয়েকটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সেগুলো মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান পেশ করছে।
কোরিয়ান ভাষায় পবিত্র কোরআন অনুবাদ প্রকাশসহ বেশ কিছু প্রকাশনার কাজও তারা যথারীতি আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে।
এছাড়াও কোরিয়ায় মুসলিমদের ক্রমবর্ধমান অভিবাসনের ফলে কোরিয়ায় মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কোরীয়দের মাঝেও দিন দিন ইসলাম জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
পরিশেষে, মুসলিমদের সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে কোরিয়ান সংস্কৃতির মিল থাকাসহ, তাদের সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিমদেরকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসহ ও ধর্মচর্চার নিরাপত্তা প্রদানের জন্য কোরিয়ায় মুসলিমদের সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করা হয়।