বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় তৈরির প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। রোববার (২৭ অক্টোবর) প্রধান বিচারপতির নির্দেশক্রমে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন আইন মন্ত্রণালয়ে এ প্রস্তাব পাঠান। সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিদের মতামত নিয়ে প্রস্তাবটি পাঠানো হয়।
প্রস্তাবনার সঙ্গে বিচার বিভাগীয় সচিবালয় অধ্যাদেশ-২০২৪-এর খসড়া, আলাদা সচিবালয়ের অর্গানোগ্রাম এবং রুলস অব বিজনেস ১৯৯৬ ও অ্যালোকেশন অব বিজনেস সংশোধনের প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে।
প্রস্তাবনায় বলা হয়, বাংলাদেশ সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ধরে বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব প্রয়োগের প্রবণতার যে চর্চা চলছে, তা রোধে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এর ফলে স্বাধীনতার পর থেকে দেশে আইনের শাসন ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা চর্চার সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নিশ্চিতকরণকে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
সংবিধানে বিচার বিভাগকে আলাদা রাখার কথা বলা হলেও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তার কার্যকর বাস্তবায়ন অসম্পূর্ণই থেকে গেছে। এমন প্রেক্ষাপটেও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এক মামলার রায়ে (যা মাসদার হোসেন মামলা নামেই অধিক সমাদৃত) নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের পূর্ণ রূপরেখা তুলে ধরার মাধ্যমে ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির বাস্তবায়নের পথকে সুগম করেছে। ওই রায়ে তুলে ধরা রূপরেখার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হলো দেশের বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা।
প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়, ওই রায়ে প্রচলিত দ্বৈত শাসন কাঠামো তথা অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, শৃঙ্খলা ইত্যাদি বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের যৌথ এখতিয়ারকে সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠাকে ক্ষমতার পৃথকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে রাজনৈতিক সরকারের অনীহার কারণে যা সম্ভব হয়নি। এ কারণে জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মাসদার হোসেন মামলার রায় বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের এটাই শ্রেষ্ঠ সময়, যার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন ও পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা। কেননা, এটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই দক্ষ, নিরপেক্ষ ও মানসম্পন্ন বিচার কাজের মাধ্যমে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
প্রস্তাবনায় বলা হয়, সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রি অধস্তন আদালতের বিভিন্ন বিষয় পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট তথা হাইকোর্ট বিভাগকে সাচিবিক সহায়তা দিয়ে থাকে। কিন্তু এ তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ নয়। কারণ আইন মন্ত্রণালয় থেকে অধস্তন আদালত সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রস্তাব আসার পরই হাইকোর্ট বিভাগ তার এসব ক্ষমতা প্রয়োগ করে। কিন্তু সংবিধান অনুসারে অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ হাইকোর্ট বিভাগের একচ্ছত্র অধিকার।
দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ গত ২১ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের ইনার গার্ডেনে দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে অভিভাষণ দেন। সে সময় অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতি, বিচার বিভাগ সংস্কার সংক্রান্ত কমিশনের চেয়ারম্যান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানসহ সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ও সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন।
অভিভাষণে দেশের বিচার বিভাগের জন্য একটি রোডম্যাপ তুলে ধরেন প্রধান বিচারপতি। যেখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বতন্ত্রীকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক পৃথকীকরণের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়। বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় স্থাপনের জন্য শিগগির পদক্ষেপ নেবেন বলেও অভিভাষণে উল্লেখ করেন তিনি।