১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারি রাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির প্রধান নেতা সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদার ক্রসফায়ারে খুন হয়। এ হত্যার দায় শেখ মুজিবকেই নিতে হবে। সেই সঙ্গে ফ্যাসিস্ট সরকারের অন্যতম প্রধান ভিকটিম সিরাজ সিকদার।
রোববার (২৭ অক্টোবর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যার লেখা ‘পাহাড়ের লাল আখ্যান’ বইয়ের আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথা বলেন।
ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনে বাংলাদেশে ‘ফ্যাসিবাদ’ বিলুপ্ত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ’আগে যা ছিল এখনো তাই আছে’ মন্তব্য করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, ‘পাহাড়ে লাল আখ্যান’ বই অনেকটা অজানা জায়গা পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে অনেক তথ্য জানাচ্ছে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রধান সিরাজ সিকদারের ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে এ বইয়ের প্রকাশ ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবির বলেন, ‘ফ্যাসিবাদ একটি গালি না, এটা রাজনৈতিক দর্শন। প্রতিটি দর্শনের মধ্যে কিছু মৌলিক গুণ থাকে। যেখানে উগ্র জাতীয়তাবাদ, ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ, কার্লট নির্মাণ, অপনেন্টদের হত্যা করা। শেখ মুজিবুর রহমান দেশে একদলীয় শাসন প্রচলন করেছিলেন, চারটি গণমাধ্যম রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সব রাজনৈতিক দল বন্ধ করে, একটি দল হয়ে গেল, হয়ে গেলো, এক নেতা, এক দেশ! শেখ মুজিবের এই ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার প্রথম ভিক্টিম ছিলেন সিরাজ সিকদার। কেননা ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থায় রাষ্ট্র ব্যবস্থায় চালিয়ে যাওয়া কঠিন ছিল। সিরাজ সিকদার ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক প্রবক্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্রভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন, একারণেই তাকে হত্যা করা হয়।’
সিরাজ সিকদার হত্যার দায় শেখ মুজিবকেই নিতে হবে উল্লেখ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘সিরাজ সিকদার কিন্তু শেখ মুজিবের রাজনীতি এবং অনেক বাম রাজনীতি থেকে অনেক দূরে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শেখ মুজিবকে আহ্বান জানান আপনার নেতৃত্বে এখানে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করুন। পরবর্তীতে সিরাজ সিকদারকে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সশস্ত্র কর্মসূচি দিতে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই সিরাজ সিকদারকে পরিণত সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গেছে। অথচ যখন সিরাজ সিকদারকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়, শেখ মুজিবের তখনকার যে বক্তব্য; সে বক্তব্য থেকেই শেখ মুজিবের দায় পুরোপুরিভাবে আসে। এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান দায় তাকেই (শেখ মুজিব) নিতে হবে। আর কোন বিপদ ও ঝুঁকি নেই! অথচ যেই ব্যবস্থা শেখ মুজিব তৈরি করেছিল সেই ব্যবস্থাই তাকে হত্যা করে আরেকটি সামরিক ইতিহাসের মাধ্যমে আমরা প্রবেশ করি।’
“পাহাড়ের লাল আখ্যান” বইয়ের গুরুত্ব নিয়ে গবেষক ও কলামিস্ট আলতাফ পারভেজ বলেন, ‘এত বড় একটা জুলাই গণঅভ্যুত্থান হলো, ছয়টি কমিশন গঠন করা হলো কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কোন কমিশন গঠন করা হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে সত্য-মিথ্যার যে লড়াই রয়েছে, সেক্ষেত্রে পাহাড়ের লাল আখ্যান বইটির অধ্যায়ন দরকার।’
বইটির অন্যতম লেখক সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির সভাপতি এবং বাংলাদেশ সরকারে প্রথম ক্রসফায়ারে নিহত সিরাজ সিকদার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ববাংলায় বিপ্লবী সর্বহারা পার্টির অনুশীলন নিয়ে অজানা বিভিন্ন বিষয় বইয়ে তুলে ধরা চেষ্টা করেছি। এটা যদি আজকে প্রকাশ না হতো পার্বত্য চট্টগ্রামের যে একটি ইতিহাস সেটি আলোর মুখ দেখত না। এখানে কিছু খণ্ডাংশ তুলে ধরা হয়েছে, এখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি কার্যক্রমের লিপিবদ্ধের ইতিহাসের বিষয়টি কিছুটা অসম্পূর্ণ রয়েছে। যদি সেই বিপ্লবের ইতিহাস তুলে না ধরা হয় বিপ্লবী সেইসব ইতিহাস হারিয়ে যাবে। কাজেই যার যার জায়গাতে থেকে চেষ্টা করে যেতে হবে, হয়ত চাইলেই আরো অনেক কিছু জানা যাবে। ভবিষ্যতে পরবর্তী সংস্করণে আরও বেশি কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করব। কেননা এটা ইতিহাসের অংশ।’
এতে অন্যান্যদের মধ্যে লিটল ম্যাগাজিন খননের সম্পাদক বাদল শাহ, সিরাজ সিকদার স্টাডিজ সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক শিপলু রহমান বক্তব্য রাখেন।
উল্লেখ্য, সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা ছাড়া ‘পাহাড়ের লাল আখ্যান’ বইয়ের অন্যান্য লেখকেরা হলেন- অনন্ত সিংহ ও অং চিং। পার্বত্য চট্টগ্রামে সিরাজ সিকদার ও পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ওপরে লেখা ২৫৬ পৃষ্ঠা বইটি আদর্শ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে।