বহুল আলোচিত সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের খোঁজ মিলেছে। তিনি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে তার আলিশান বাড়িতে অবস্থান করছেন। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার অনুসন্ধানে এ তথ্য জানা গেছে।
সোমবার (২১ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, আল জাজিরার তদন্তকারী ইউনিট (আই-ইউনিট) জানতে পেরেছে যে, বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বর্তমানে লন্ডনে ১৪ মিলিয়ন ডলারের একটি বাড়িতে বসবাস করছেন। অথচ তার বিরুদ্ধে ব্রিটেনে মিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষ। তদন্তের সময় সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ ও তার স্ত্রী রুকমীলা জামানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।
সম্প্রতি তিনি অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের ক্যামেরায় ধরা পড়েন। তাকে আলিশান বাড়িটির আঙিনায় হাঁটতে দেখা যায়। ওই এলাকায় ছয়টি অ্যাপার্টমেন্ট তার মালিকাধীন। যার বর্তমান বাজার মূল্য ৯ মিলিয়ন ডলারের বেশি।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান। এ সময় সাইফুজ্জামানও পালিয়ে যান। তবে তার অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। অবশেষে লন্ডনে তার খোঁজ মিলল।
সাবেক ভূমিমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট অবস্থান জানার আগেই ৭ অক্টোবর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক রাম প্রসাদ মণ্ডলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আস-সামছ জগলুল হোসেন দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন।
ওই দিন দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মীর আহমেদ আলী সালাম আদালতে শুনানি করেন। দুদকের আবেদনে বলা হয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থে দেশের অভ্যন্তরে সম্পদ অর্জন ও বিদেশে পাচার করে নিজ নাম এবং পরিবারের সদস্যদের নামে যুক্তরাজ্যে ৩৫০টি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৮টি এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৯টিসহ অন্যান্য দেশে বাড়ি ও এপার্টমেন্টের পাশাপাশি অন্যান্য সম্পদ অর্জন করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে দুদক।
এ ছাড়া সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ ও তার স্ত্রী রুকমিলা জামানের মালিকানাধীন স্থাবর সম্পদ জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুদক উপপরিচালক রাম প্রসাদ মণ্ডলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ আস সামছ জগলুল হোসেনের আদালত এ আদেশ দেন। দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সাইফুজ্জামান ও তার স্ত্রীর সব ধরনের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। পরে সাইফুজ্জামানের ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী, আনিসুজ্জামানের স্ত্রী ইমরানা জামান চৌধুরী ও মেয়ে আনিছা জামানের ব্যক্তিগত হিসাব ও তাদের ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে পরিচালিত হিসাবের লেনদেন প্রথম দফায় ৩০ দিনের জন্য স্থগিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে ২৫০ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা) খরচ করে ৩৬০টি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন। এ তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
আল জাজিরার অনুসন্ধানী ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে ২৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে ৩৬০টি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন। নিজের রিয়েল স্টেট ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করেছেন ব্রিটেন ছাড়াও দুবাই, নিউইয়র্ক, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়ায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইফুজ্জামানের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। যা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। সাবেক এই ভূমিমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমার বাবা শেখ হাসিনার খুব কাছের লোক ছিলেন। আমিও তার কাছের লোক, হাসিনা আমার বস। তিনি জানেন যুক্তরাজ্যে আমার ব্যবসা আছে।’
আলজাজিরা জানিয়েছে, ২০১৭ সালের দিকে সাইফুজ্জামান চৌধুরী সম্পদ কেনা বাড়িয়ে দেন। ২০১৯ সালে যখন তিনি মন্ত্রী হন তখন এটি আরও বেড়ে যায়।
সংবাদমাধ্যমটি জানায়, গত বছর বিনিয়োগকারীর ছদ্মবেশে আল জাজিরার সাংবাদিক সাইফুজ্জামানের ১৪ মিলিয়ন ডলারের বাড়িতে যায়। ওই সময় ‘ছদ্মবেশী’ সাংবাদিকদের সাইফুজ্জামান বড়াই করে জানান, তিনি কুমিরের চামড়ার হাতে তৈরি জুতার ওপর হাজার হাজার ডলার খরচ করেন এবং লন্ডনের সবচেয়ে দামি দোকান থেকে ইতালিয়ান স্যুট তৈরি করে পরেন।
এ সময় সাইফুজ্জান লন্ডনের নিজের বাড়িও ঘুরিয়ে দেখান তাকে। যেটিতে রয়েছে সিনেমা হল, জিম, ব্যক্তিগত এলিভেটর এবং নতুন রোলস রয়েলস গাড়ি রাখার নিরাপদ আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং এরিয়া।
সাইফুজ্জামান আল জাজিরার কাছে দাবি করেছেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও আরব আমিরাতে নিজের বৈধ ব্যবসার মাধ্যমে এই সম্পদ কিনেছেন তিনি। তবে অন্তর্বর্তী সরকার তার বিরুদ্ধে এখন অর্থপাচারের অভিযোগ এনে তদন্ত শুরু করেছে। ইতোমধ্যে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ এবং তার পরিবারের মালিকানাধীন ইউসিবিএল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
আল জাজিরার ইউটিউব অ্যাকাউন্ট ও ওয়েবসাইটে সাইফুজ্জামানকে নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী। তিনি দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সংসদ সদস্য। সাইফুজ্জামান চৌধুরী মূলত তার বাবার মাধ্যমে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তার বাবা চট্টগ্রামের আনোয়ারা আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর ওই আসনে উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এরপর ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবার নির্বাচিত হন।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের নির্বাহী কমিটি চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলাদেশের শিল্প প্রতিষ্ঠান আরামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি চট্টগ্রাম চেম্বার অব কর্মাস এন্ড ইন্ডাস্ট্রির তিনবারের নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন।