Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

কেয়া কসমেটিক্সের জনপ্রিয়তা ধ্বসের কারণ

বাংলাদেশের এক সময়ের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড কেয়া কসমেটিকস। এক সময়ের জনপ্রিয় বলার কারণ হলো এই প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীরা কেয়া কসমেটিকসের জনপ্রিয়তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই জানেনা। কিন্তু নব্বই দশকে এই কসমেটিকসের ব্র্যান্ডটির জনপ্রিয়তা ছিলো তুঙ্গে। এর প্রধান কারণ ছিলো কেয়ার বিজ্ঞাপনগুলো। নব্বই দশকে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে কেয়ার মডেল ছিলো মৌ-নোবেল ও শম্মী কায়সাররা। যারা কেয়ার বিজ্ঞাপন দিয়ে রাতারাতি হার্টথ্রব সেলিব্রেটি হয়ে গিয়েছিলো। পাশাপাশি সেই সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয় ম্যাগাজিন টেলিভিশন শো ইত্যাদিকে স্পন্সর করতো এই ব্র্যান্ডটি। ফলে ইত্যাদির জনপ্রিয়তার সঙ্গে কেয়া ব্র্যান্ডের জনপ্রিয়তা বেড়েছিলো সমানতালে।

chardike-ad

বিউটি সোপ, লিপ জেল, নারকেল তেল বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনীর চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন প্রচার করা কেয়া কোম্পানি ১৫ শতাংশের বেশি বাজার শেয়ার দখল করেছিল। তবে গত কয়েক বছর ধরে কেয়া কসমেটিকস পণ্যের বিজ্ঞাপন খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। মানুষ কেয়ার পণ্য কিনছেও না। বহুল জনপ্রিয় এই কোম্পানির হঠাৎ কেন পতন হলো?সেই প্রশ্নের উত্তরই জানবো এই রিপোর্টে-

১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কেয়া কসমেটিকস। শুরুতে সাবান পণ্যটিকে প্রসার ও প্রচারের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করে কেয়া। পরবর্তীতে কয়েকটি রং এবং সুগন্ধ যোগ হয় কেয়ার সাবানে।  কোম্পানিটি পরবর্তীতে পেট্রোলিয়াম জেলি, লিপ জেল, ডিটারজেন্ট পাউডার, শেভিং ক্রিম, শ্যাম্পু ইত্যাদি উৎপাদন শুরু করে।  কেয়ার প্রধান কাঁচামাল হল সোডিয়াম লবণ, পাম তেল, এবং পরিশোধিত, ব্লিচড এবং কোকো তেল। এই কাঁচামাল তারা বাইরের দেশগুলো থেকে আমদানি করে থাকে। কেয়া সুইস কোম্পানি ক্ল্যারিয়ান্ট এবং জার্মান কোম্পানি বিএএসএফ থেকে রঙের সামগ্রীও আমদানি করে। অন্যদিকে কেয়া পণ্য সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এবং মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে রপ্তানি করা হয়। যার শুরু সেই ১৯৯৮ থেকেই করেছিলো তারা।

বিউটি সাবান তৈরি করে বিউটি বার সোপ ক্যাটাগরিতে বাজারে অন্যান্য ব্র্যান্ডের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৫৪ শতাংশ বাজার এই পণ্যের অধীনে ছিলো। এই পণ্যের সফলতা দেখে  কেয়া পরে এই সুপার বিউটি সোপের একটি মিনি সংস্করণও চালু করে তারা। কেয়া পরে বল সাবান এবং গ্লিসারিন লন্ড্রি সাবান তৈরি করে লন্ড্রি সাবানের বাজারে প্রবেশ করেন। হারবাল বিউটি সোপ এবং স্কিন কেয়ার সোপ উৎপাদনের মাধ্যমে কোম্পানিটি ধীরে ধীরে প্রায় সব বিভাগেই প্রবেশ করেছে। খুবই কম সময়ের মধ্যে কেয়া বল সাবানের জনপ্রিয়তা ছিলো চোখে পড়ার মতো।  কিন্তু এরপরেই শুরু হয় কেয়ার পতন।

আর এই পতনের পিছনে মালিকপক্ষ ও নির্বাহী কর্মকর্তাদের কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরে আসাকেই দায়ী করা হয়।  কসমেটিকস বাজারে স্বল্প সময়ের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে কেয়া গার্মেন্টস ব্যবসায় প্রবেশ করতে শুরু করে। এসব পোশাক কারখানা নির্মাণ ও অন্যান্য বিনিয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠানটি অনেক ঋণ নেয়। বিশ্ববাজারে তুলার দামের অস্থিরতার কারণে কোম্পানিটি ২০১০ সালেও বেশি দামে তুলা কিনেছিল। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে এবং সে অনুযায়ী বিক্রি করতে না পারায় আশানুরূপ মুনাফা করা সম্ভব হয়নি।  সেজন্য স্বাভাবিকভাবেই মূল প্রসাধনী ব্যবসা থেকে তাদের ফোকাস সরে যায়। এবং কসমেটিকসের বাজারও তারা হারাতে শুরু করে।

২০১০-১১ সালে কোম্পানিটির প্রায় ৫০০ কোটি টাকার রপ্তানি আদেশ বাতিল করা হয়। এরপর থেকে নিয়মিত ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যবসায়িক ইউনিটগুলো একীভূত করা, পুঁজিবাজারে শেয়ার ইস্যুসহ নানা বিষয়ে শেষ রক্ষা হয়নি। ২০১২ সালে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতার নাম বিভিন্ন ব্যাংকের খেলাপির তালিকায় চলে যায়। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ বার্ষিক প্রতিবেদনে, কেয়া কসমেটিক্সের প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ বকেয়া ছিল।

দেশের গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে ২০১৫ সালে প্রসাধনী খাতে কেয়ার বাজারের অংশ ৫ শতাংশ ছিল।  ২০১৬-১৭ অর্থবছরের আগে যেখানে দেশের বাজারে কেয়ার বিক্রি ছিল ২৬০ কোটি টাকা, এর পরের অর্থবছরে তা প্রায় অর্ধেক কমে ১৪০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। দেসের বাজারে এখনও প্রসাধনী সামগ্রীর ব্যাপক চাহিদা থাকা স্বত্ত্বেও কেয়ার নির্বাহী পরিচালকগণ গ্রাহকদের এই চাহিদাকে অবহেলা করে যাচ্ছে। এমনকি ডিটারজেন্ট ও সাবান উৎপাদনও তারা সীমিত করে ফেলেছে।

২৩ জুন ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত শীর্ষ ৩০০ ঋণ খেলাপির তালিকায়, কেয়া কোম্পানি পুঁজিবাজারের শীর্ষ ১০ কোম্পানির মধ্যে ছিল এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা। বর্তমানে ঋণ পরিশোধ তুলনামূলক স্বাভাবিক বলে বিভিন্ন ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

বিজ্ঞাপনে দূর্বলতা

এক সময় রেডিও ও টিভিতে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করা কেয়ার বিজ্ঞাপনে পিছিয়ে পড়া এক অনন্য ব্যর্থতা।কেয়া এখনও ম্যাগাজিন শো ইত্যাদির স্পন্সর হিসেবে কাজ করছে, কিন্তু জনপ্রিয়তার দিক থেকে ইত্যাদির অবস্থান এখন আর কতটা রয়েছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কিন্তু কেয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিরা একটি বা দুটি মাধ্যমের ওপর নির্ভর না করে বিস্তৃতভাবে মার্কেটিং কৌশল অনুসরণ করছে। যেমন : লাক্স বিভিন্ন নাটক সিরিয়ালের টাইটেল স্পন্সরশিপ, লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টারের স্পন্সরশিপ, বিলবোর্ড মার্কেটিং, সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সকল মাধ্যমে পণ্যের প্রচার করে।

শেয়ার মার্কেটে ধ্বস ও কেলেঙ্কারি

শেয়ারবাজারে কোনো কোম্পানির যাওয়া মানে গ্রাহক এবং শেয়ার অংশিদারদের সঙ্গে সৎ ও কেয়ারফুল সম্পর্ক তৈরি করতে হয়। এর দ্বিতীয়টা হলে বড় বড় কোম্পানিও ধ্বসের মুখে পড়ে। যেটা কেয়ার সঙ্গে ঘটেছে। গত ১৪ বছর শেয়ারবাজারে কেয়ার অবস্থান সন্তোষজনক নয়। কোম্পানিটি ২০১০ সাল থেকে কোনো নগদ লভ্যাংশ দেয়নি।

২০১১ সালে, কেয়া তার ঋণ পরিশোধের জন্য একটি রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ১০০কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিল। ঋণ পরিশোধের জন্য মালিক বিভিন্ন সময়ে শেয়ারও বিক্রি করেছেন। কোম্পানির পৃষ্ঠপোষক পরিচালকদের শেয়ারহোল্ডিং এই বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৬ শতাংশ ছিল, যা ২০১৭ সালেও ছিল ৬৩ শতাংশ। যা শেয়ার বাজারে ব্যর্থতার একটি অনন্য উদাহরণ।

২০১৭-১৮ অর্থবছরের পরে কোম্পানির কোনো বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি, কোনো ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। আদালতের নির্দেশে ২০২১ ও ২০২২ সালে এজিএম বন্ধ থাকার পর ২০২৩ সালের অক্টোবরে কোম্পানিটির ২২তম এজিএম অনুষ্ঠিত হয়। ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি), বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বর্তমানে কেয়া রাজস্ব এবং মুনাফা রিপোর্টিং তদন্ত করছে।

কেয়া কঠিন কাজকে সহজ করে স্বল্প সময়ে বাজারে ভালো অবস্থানে যেতে পেরেছিল পণ্যের গুণমান, মূল্য এবং জনপ্রিয়তা। কিন্তু সময়ের সাথে নতুন আইডিয়া না নিয়ে, ভুল কৌশল, পণ্যের বৈচিত্র্যের অভাব এবং সরবরাহ অনিয়মের কারণে কোম্পানিটি পতনের মুখে পড়ে । বিশ্লেষকরা মনে করেন দেশীয় কিংবদন্তী ব্র্যান্ডটি যদি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতো এবং প্রতিদ্বন্দ্বী ব্র্যান্ডগুলোর স্ট্র্যাটেজির সাথে তাল রেখে নিজেদের নতুনত্ব ধরে রাখতে পারত তাহলে অন্যান্য বিদেশী নামী ব্র্যান্ডের সাথে কেয়াও সমান অবস্থানে থাকত।