দেশের নেটওয়ার্ক সরবরাহ ব্যবস্থাপনা গতিশীল ও বিকেন্দ্রীকরণ করতে ২০০৮ সালের জুলাইয়ে নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে ফাইবার অ্যাট হোম। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ৭ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটি লাইসেন্স গ্রহণ করে। সে বছরই প্রযুক্তি খাতে ব্যবসা নিয়ে আসে ফরিদ খানের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সামিট কমিউনিকেশন লিমিটেড। ফাইবার অ্যাট হোমের পথ অনুসরণ করে প্রথমেই নেন এনটিটিএন লাইসেন্স। তার পর থেকে দেশের প্রযুক্তি খাতের ব্যবসা তিনি একচেটিয়া দখলে নেন।
দেশের ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক সরবরাহ ব্যবস্থাপনার প্রধান অনুষঙ্গ বিবেচনা করা হয় ব্যান্ডউইডথ আমদানি ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনাকে। নেটওয়ার্ক সরবরাহ ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রিত হয়ে আছে মাত্র দুটি কোম্পানির মধ্যে। এতে যেমন প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হয়নি, একই সঙ্গে দুর্যোগকালে বিঘ্ন ঘটতে পারে এ ব্যবস্থায়।
বিটিআরসির এনটিটিএন গাইডলাইনের ২৫ ধারায় সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। অথচ তার জন্য প্রয়োজনীয় লাইসেন্স অনুমোদন দেয়নি বিটিআরসি। মাত্র দুটি কোম্পানির মধ্যেই তা নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়। ২০১৯ সালে নতুন করে লাইসেন্সের অনুমোদন পায় বাহন লিমিটেড।
২০১৮ সালে টেলিযোগাযোগ খাতের কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্য বিটিআরসি ‘এসএমপি নীতিমালা ২০১৮’ প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়েছে, গ্রাহকসংখ্যা, রাজস্ব আয়ের একটিতে কোনো অপারেটরের ৪০ শতাংশের বেশি দখলে থাকলে সেটিকে ‘এসএমপি অপারেটর’ হিসেবে ঘোষণা দিতে পারবে বিটিআরসি। যদিও সেই এসএমপি নীতিমালা বাস্তবায়ন হয়নি টেলিযোগাযোগ খাতের এসব অপারেটরের ওপর।
বিটিআরসি সূত্রে জানা যায়, মূলত রাজনৈতিক প্রভাবে সামিট কমিউনিকেশনের ওপর এসএমপি বিধিমালা আরোপ করা যায়নি। উল্টো আরো বেশি লাইসেন্স ও সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে কোম্পানিটিকে। সর্বশেষ সাবমেরিন কেবলের যৌথভাবে লাইসেন্স পায় সামিটসহ তিন কোম্পানি।
বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, টেলিযোগাযোগ খাতে অবকাঠামো উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে চার ধরনের অপারেটর। এসব অপারেটরের ওপর সারা দেশের নেটওয়ার্ক সরবরাহ ব্যবস্থা নির্ভর করে। অপারেটরগুলোর মধ্যে রয়েছে সাবমেরিন কেবল কোম্পানি, ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্ট্রিয়াল কেবল (আইটিসি), ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি), নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) অপারেটর। এ চার অপারেটিং সিস্টেমের মধ্যে তিনটিতে একচেটিয়া আধিপত্য তৈরি হয়েছে সামিট কমিউনিকেশন লিমিটেড ও ফাইবার অ্যাট হোমের। এর মধ্যে সাবমেরিন কেবল স্থাপনেও লাইসেন্স পেয়েছে বেসরকারি টেলিকম কোম্পানি সামিট কমিউনিকেশন লিমিটেড। সব ধরনের লাইসেন্স থাকায় সামিট গ্রাহককে আইটিসি থেকে ব্যান্ডউইডথ কিনতে বাধ্য করছে। সেই সঙ্গে সরবরাহ চেইন থাকায় ফাইবার অ্যাট হোমের গ্রাহকরাও তাদের থেকে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
এ চার লাইসেন্স ছাড়াও সামিট অনুমোদন নিয়েছে সাবমেরিন কেবল কোম্পানি, টাওয়ার কোম্পানি, আইসিএক্স, এনআইএক্স ও আইজিডব্লিউ লাইসেন্স। এর মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ খাতে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করেছে কোম্পানিটি।
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা জানান, একটি বা দুটি কোম্পানির ওপর সারা দেশের নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাকে নির্ভরশীল করে তোলা দেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। দুর্যোগকালেও নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এ ধরনের নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিছু ক্ষেত্রে একটি এলাকায় ইন্টারনেট সরবরাহের জন্য মাত্র একটি এনটিটিএন অপারেটর রয়েছে। এতে এক কোম্পানির কেবল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে ভিন্ন কোনো সংযোগ ব্যবস্থা খুঁজে পাওয়া যায় না। এ সময় ইন্টারনেট যোগাযোগহীন অবস্থায় পড়ে যায় ওই নির্দিষ্ট এলাকা।
তারা বলেন, এতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা যায় না। এতে এক অপারেটরের একচেটিয়া আধিপত্য ইন্টারনেট ব্যয় বৃদ্ধি করে ফেলে। যদি অন্তত দুই-তিনটি কোম্পানির প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা যেত তাহলে ইন্টারনেট সহজলভ্য হতো, একই সঙ্গে প্রতিযোগিতাও নিশ্চিত হতো।
জানতে চাইলে দেশের একটি অপারেটরের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা (সিটিও) বলেন, ‘সামিট ও ফাইবার অ্যাট হোমের ওপর নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এর জন্য লাইসেন্সধারী অন্য অপারেটররা গ্রাহক সংযোগ নিশ্চিত করতে পারছে না। তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোথাও নিজেদের নেটওয়ার্ক অবকাঠামো স্থাপন করতে গেলে সেখানে হয় সামিট অবস্থান করছে অথবা ফাইবার অ্যাট হোম। একই সঙ্গে এ দুই কোম্পানির কাছে ডাটা সরবরাহের লাইসেন্স আইটিসি ও আইআইজি রয়েছে। আবার ডাটা সরবরাহের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত এনটিটিএন লাইসেন্সও রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা এবং সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
বিটিআরসির থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১ লাখ ৮১ হাজার ৫১৭ কিলোমিটার ফাইবার অপটিক্যাল কেবল রয়েছে। ফাইবার অপটিক্যাল কেবল স্থাপনের জন্য ২০০৯ সাল থেকে লাইসেন্স দিয়ে আসছে বিটিআরসি। প্রথম অপারেটর হিসেবে ফাইবার অ্যাট হোমকে এ লাইসেন্স প্রদান করা হয়। এর মধ্যে লাইসেন্স প্রদানের আগে নিজস্ব প্রয়োজনে সেলফোন অপারেটর গ্রামীণফোন লিমিটেড, বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশন, রবি আজিয়াটা লিমিটেড, টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড ও প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড এসব কেবল স্থাপন করে। সেলফোন অপারেটরদের স্থাপিত কেবলের দৈর্ঘ্য ৯ হাজার ৭১১ কিলোমিটার। অর্থাৎ এনটিটিএন অপারেটরদের স্থাপিত কেবলের দৈর্ঘ্য ১ লাখ ৭১ হাজার ৮০৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে শুধু দুই অপারেটর স্থাপিত অপটিক্যাল ফাইবার কেবলের দৈর্ঘ্য ১ লাখ ২২ হাজার ৬৪৫ কিলোমিটার। বেসরকারি অপারেটর বাহন লিমিটেডের কেবল রয়েছে ২ হাজার ২২৬ কিলোমিটার।
বর্তমানে বাংলাদেশ ইন্টারনেটের মাধ্যমে বহির্বিশ্বের সঙ্গে দুইভাবে সংযুক্ত। একটি হলো সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে, অন্যটি ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্ট্রিয়াল কেবলের (আইটিসি) মাধ্যমে। সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে ব্যান্ডউইডথ সরবরাহ করছে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিপিএলসি)।
বিএসসিপিএলসির এক কর্মকর্তা জানান, সাবমেরিন কেবলের ব্যাকআপ হিসেবে ২০১২ সালে ছয়টি এবং ২০১৪ সালে একটিসহ মোট সাতটি প্রতিষ্ঠানকে আইটিসি লাইসেন্স দেয়া হয়। এ লাইসেন্সের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান ভারত থেকে বাংলাদেশে সাবমেরিন কেবলের ব্যান্ডউইডথ আমদানির সুযোগ পায়। সামিট ও ফাইবার অ্যাট হোম ছাড়া লাইসেন্সের মধ্যে রয়েছে নভোকম লিমিটেড, ওয়ানএশিয়া অ্যালায়েন্স কমিউনিকেশন লিমিটেড, বিডিলিংক কমিউনিকেশন, ম্যাংগো টেলিসার্ভিস ও বিটিসিএল। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যান্ডউইডথ আমদানি করে সামিট কমিউনিকেশন লিমিটেড।
সাবমেরিন কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা তৈরির জন্য এ লাইসেন্স তখন দেয়া হয়। লাইসেন্স প্রদানের পর সামিট কমিউনিকেশন লিমিটেডের আধিপত্যে কোণঠাসা হয়ে পড়ে স্বয়ং বিএসসিপিএলসি।
বর্তমানে দেশে মোট ব্যান্ডউইডথ ব্যবহার হয় ৬২০০ জিবিপিএস। এর মধ্যে বিএসসিপিএলসি সরবরাহ করছে ২৯০০ জিবিপিএস। বাকি ৩৩০০ জিবিপিএস সরবরাহ করছে সাতটি আইটিসি অপারেটর। এর মধ্যে সামিট কমিউনিকেশন সরবরাহ করছে দুই হাজার জিবিপিএসের বেশি। ফাইবার অ্যাট হোম সরবরাহ করছে ১ হাজার ১০০ জিবিপিএস।
বিএসসিপিএলসি কর্মকর্তারা জানান, সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে ব্যান্ডউইডথ সরবরাহের কথা থাকলেও ব্যাকআপ হিসেবে চালু হওয়া আইটিসিই মূলত দেশের ব্যান্ডউইডথ সরবরাহের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে ভারত থেকে ব্যান্ডউইডথ আমদানি বাড়তে থাকে।
বিএসসিপিএলসি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির অধীনে দুটি সাবমেরিন কেবল রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে এসএমডব্লিউ-৫, অন্যটি এসএমডব্লিউ-৪। এসএমডব্লিউ-৪-এর মাধ্যমে ৪ হাজার ৬৫০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইডথ এবং এসএমডব্লিউ-৪-এর মাধ্যমে ২ হাজার ৫৫০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইডথ সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে। সর্বমোট ৭ হাজার ২০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইডথ সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে বিএসসিপিএলসির। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ২ হাজার ৭০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইডথ সরবরাহ করতে পারে। বাকি ব্যান্ডউইডথ অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে।
সরকারের লাভজনক এ প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে আইটিসি অপারেটরদের লাইসেন্স প্রদানের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন পত্রে নানা সময়ে এ নিয়ে কথা বলা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বিএসসিসিএলের পাশাপাশি ছয়টি আইটিসি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সাবমেরিন কেবলের ব্যান্ডউইডথ সরবরাহ করছে এবং উল্লেখযোগ্য বাজার দখল করতে সক্ষম হয়েছে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতে আরো তিনটি প্রতিষ্ঠানকে সাবমেরিন কেবল লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি প্রতিষ্ঠানের এনটিটিএন লাইসেন্স রয়েছে। বেসরকারি খাতের লাইসেন্সধারীরা আগামী দুই বছরের মধ্যে বেসরকারি কার্যক্রম আরম্ভ করবে মর্মে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে বিএসসিসিএলের বাজার সংকুচিত হতে পারে।
গত ২৪ জুলাই বিএসসিপিএলসির কক্সবাজার ল্যান্ডিং স্টেশনের জমি এবং সাবমেরিন কেবলের পিভিসি ডাক্ট লিজ নিতে আবেদন জানায় বেসরকারি সাবমেরিন কেবলের তিন কোম্পানি। সামিট কমিউনিকেশনের প্যাডের ওই আবেদনে দেখা যায়, ল্যান্ডিং স্টেশনের ৩০-৩৩ শতাংশ জমি এবং একটি চার ইঞ্চির পিভিসি ডাক্ট লিজ নিতে চায় কোম্পানি তিনটি। এজন্য সুনির্দিষ্ট করে পিভিসি ডাক্টের অব্যবহৃত দুটি ডাক্টের কথা উল্লেখ করা হয়। মাটির নিচে থাকা এ ডাক্টের কথা বিএসসিপিএলসি কর্তৃপক্ষ ছাড়া কেউ জানার কথা নয়।
কোম্পানির এক কর্মকর্তা জানান, মূলত সাবমেরিন কেবল প্রাইভেট খাতে দেয়ার উদ্যোক্তা ছিলেন সিডিনেট কমিউনিকেশনের সিইও মশিউর রহমান। তিনি একসময় বিএসসিপিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।