বহুল আলোচিত চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার রায় ঘোষণার জন্য ৯ মে দিন ধার্য করেছেন আদালত।
আজ সোমবার (২৯ এপ্রিল) ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক অরুণাভ চক্রবর্তী রায়ের জন্য এ দিন ধার্য করেন। আজ মামলায় অধিকতর যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়। আলোচিত এই হত্যা মামলায় ৩৮ জনের মধ্যে ১০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাদিয়া আফরোজ শিল্পী। এর আগে গত ১৯ মার্চ মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আরো জানান, ৩৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১ জন মারা গেছেন। ১০ জন বাদে ১২ জন সাক্ষীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মামলার আসামিরা হলেন: ট্রাম্পস ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম, ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই ওরফে আব্দুল আজিজ, তারেক সাঈদ মামুন, সেলিম খান, হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন ওরফে বস লিটন, ফারুক আব্বাসী, আদনান সিদ্দিকী, শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন এবং আশিষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী। এদের মধ্যে আশিষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী, তারেক সাঈদ মামুন, ফারুক আব্বাসী জামিনে থেকে আদালতে হাজিরা দেয় এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনকে আদালতে হাজির করা হয়। বাকিদের মধ্যে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ওরফে আব্দুল আজিজ, ট্রাম্পস ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম, সেলিম খান, হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন ওরফে বস লিটন ও আদনান সিদ্দিকী পলাতক রয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানীর আবেদিন টাওয়ারে অবস্থিত ট্রাম্পস ক্লাবের নিচে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনার পরপরই নায়কের বড়ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী বাদী হয়ে গুলশান থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। চাঞ্চল্যকর এই মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় গোয়েন্দা পুলিশকে।
১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার আবুল কাশেম ব্যাপারী চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই সহ নয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০০১ সালের ৩০ অক্টোবর ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এর দুই বছর পর মামলাটির বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ঢাকার দুই নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।
হত্যার বিষয়ে সোহেল চৌধুরীর মা নূরজাহান বেগম আদালতের জবানবন্দিতে বলেন,তাঁদের বাসার উল্টোদিকে ট্রাম্পস ক্লাব। হত্যাকাণ্ডের দিন রাত দুইটার দিকে সোহেল বাসায় ফেরেন। ক্লাবের সামনেই ছিলো জামে মসজিদ। পরে সোহেল আবার ক্লাবে গেলে সন্ত্রাসীরা তাঁকে দুটি গুলি করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, সোহেল খুন হওয়ার মাত্র ১৫ থেকে ২০ দিন আগে টেলিফোনে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও বান্টি ইসলামের লোকজন হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, সোহেলের মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে আসছে।
২০০৩ সালে অন্যতম আসামি আদনান সিদ্দিকী মামলাটি বাতিলে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের আদেশে মামলার বিচারকাজ স্থগিত থাকে। ২০১৫ সালে সেই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এরপর হঠাৎ করেই আলোচিত এই মামলার নথি উধাও হয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। যা রিট দায়েরের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের নজরে আসে। আদালত রাষ্ট্রপক্ষকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেয়। এর সাত বছর পর ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মামলার নথি বিচারিক আদালতে ফেরত এলে নতুনভাবে বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়।
কিন্তু মামলার কেস ডকেট (সিডি) খুঁজে না পাওয়ায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যাচ্ছিলো না। শেষ পর্যন্ত কেস ডকেট ছাড়াই সাক্ষ্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২। এরপর চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত ঘোষণা করেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ এর তৎকালীন বিচারক এম আলী আহমেদ। এরপর আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তারিখ ধার্য করা হয়। গত ১১ ফেব্রুয়ারি আসামিরা আত্মপক্ষ সমর্থন করে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন।
২০২২ সালে নতুনভাবে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হলে ওই বছরের ৬ এপ্রিল অন্যতম আসামি আশিষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরীকে রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে গ্রেফতার করে এলিট ফোর্স র্যাব। জিজ্ঞাসাবাদে আশিষ জানায়, ১৯৯৬ সালে বনানীর আবেদিন টাওয়ারে তাঁর ও আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলামের যৌথ মালিকানায় ট্রাম্পস ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে রাতভর অসামাজিক কার্যকলাপ চলতো। পরে এটি ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন ও গ্যাংলিডারদের বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ক্লাবে শুরু থেকেই যাতায়াত ছিল আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের। তিনি মূলত ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণকারীদের সঙ্গে বৈঠক করতে এই ক্লাবে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সেই সুবাদে বান্টি ও আশিষের সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদের সখ্যতা হয়।
এছাড়াও আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনও ক্লাবে প্রতিনিয়ত যাতায়াত করতো।
আশিষ আরো জানায়, বনানীর আবেদিন টাওয়ারের অষ্টম তলায় অবস্থিত ট্রাম্পস ক্লাবের পাশেই ছিল বনানী জামে মসজিদ। ক্লাবে অসামাজিকতার বাড়বাড়ন্ত দেখে অভিনেতা সোহেল চৌধুরী এলাকার সচেতন নাগরিক হিসেবে মসজিদ কমিটিকে সঙ্গে নিয়ে অসামাজিক কাজ বন্ধে একাধিকবার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। এ কারণে মালিক বান্টি এবং আশিষের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর শত্রুতা তৈরি হয়। যার ফলে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে আঘাত লাগে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও সন্ত্রাসী ইমনের। তাঁদের সবার চক্ষুশূলে পরিণত হন সোহেল।
হত্যাকাণ্ডের কয়েকমাস আগে ১৯৯৮ সালের ২৪ জুলাই ক্লাবে গান বন্ধ করাকে কেন্দ্র করে উপস্থিত সবার সামনে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর হাতাহাতি এবং বাদানুবাদ হয়। একপর্যায়ে নায়কের বন্ধু কালা নাসির আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে গুলি করতে যান। পরে ক্লাব বাথরুমে ঢুকে আত্মরক্ষা করেন তিনি। ফলশ্রুতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বান্টি ও আশিষকে অনুরোধ জানায় সে। পরে তাঁরা তিনজনেই অভিনেতাকে হত্যার জন্য ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনকে প্রস্তাব দেয়।
এরপর ঘটনার রাতে অর্থাৎ ১৯৯৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর সোহেল চৌধুরী তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে রাত এগারোটার পরে ট্রাম্পস ক্লাবে ঢোকার চেষ্টা করলে বাধার মুখে পড়েন। পরে রাত আড়াইটার দিকে আবারো তিনি ক্লাবে ঢুকতে চাইলে নিচে অবস্থানরত শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন এবং আদনান সিদ্দিকী তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।