ডা. মুনতাসির সিঙ্গাপুর প্রবাসীদের কাছে পরিচিত মুখ। তিনি দেশটির সেনকাং জেনারেল হাসপাতালে সার্জারি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত। সম্প্রতি স্থানীয় একটি গণমাধ্যমে বাংলাদেশি এই চিকিৎসককে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।
জানা গেছে, করোনাভাইরাস মহামারি প্রথম যখন সিঙ্গাপুরে শুরু হয়েছিল তখন ডা. মুনতাসির পার্থ অস্ট্রেলিয়ায় ছিলেন। সেখানে তিনি শীর্ষস্থানীয় সার্জনের সঙ্গে ৬ মাসের ফেলোশিপে অংশ নিয়েছিলেন। দেশটিতে করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ায় বিদেশে অবস্থানরত মুনতাসিরসহ সহকর্মীদের মার্চের শেষ দিকে সিঙ্গাপুরে ফেরানোর সিদ্ধান্ত হয়।
সিঙ্গাপুরে ফেরত আসার পর তাকে বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। ডা. মুনতাসির সিঙ্গাপুরের অভিবাসী শ্রমিকদের ডরমেটরিতে প্রথম ভাইরাসের খবর পান। রাতারাতিই বদলে যায় দেশটির করোনা প্রেক্ষাপট। একটি বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং আতঙ্কিত হয়ে পড়ে শহরের অভিবাসীরা।
তিনি তাৎক্ষণিক বুঝতে পারেন তার কী করা উচিত। কোয়ারেন্টাইন শেষে কাজে যোগদান করেন। এরপর শুরু হয় অমানবিক পরিশ্রম। ‘এসএইচএন (স্টেহোম) শেষ হওয়ার আগেই ফোন আসে হাসপাতাল থেকে। আমাকে নির্দেশনা দেয়া হয়। এরপর করোনা মোকাবিলায় মাঠে নেমে যাই’।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘আপনি তো বাংলা বলেন। জরুরিভিত্তিতে ডরমেটরিগুলোতে আপনার সাহায্য দরকার’। কালক্ষেপণ না করে ডা. মুনতাসির তার টিম নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন। কর্মচারী, চিকিৎসক, নার্স এবং সহযোগীদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল একটি চিকিৎসক দল।
ডা. মুনতাসির বলেন, ‘প্রথম দিনগুলো খুব উদ্বেগজনক ছিল। আমরা কাজ করেছি একেবারেই এক ভিন্ন পরিবেশের মধ্যে। প্রচণ্ড গরমে পিপিই পরা অবস্থায় ছিলাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল। ঘাম গড়িয়ে পড়ছিল। আমরা বুঝতে পারছিলাম অভিবাসী শ্রমিকদের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। কতই না কষ্ট করে তারা। সেই তুলনায় আমাদের জীবন আরাম ও আয়েশের মধ্যে কাটে’।
তিনি বলেন, ‘এ অবস্থায় সবার মনোবল শক্ত রাখাটা ছিল খুবই জরুরি। উপরের নির্দেশ না থাকা সত্ত্বেও আমাদের দলনেতাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সবাই বেশ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করেছে’।
‘আপনি যদি যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো সৈনিকের কথা ভাবেন প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে যখন প্রাণ বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম তখন আপনি যদি আড়চোখে দেখেন- আপনি একা নন, পাশে আছে অধিনায়ক। তখন আপনার সাহস এবং মনোবল দুটোই দ্বিগুণ হয়ে যাবে। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল’।
তিনি আরও বলেন, ‘চিকিৎসার পাশাপাশি আমাদের টিম কর্মীদের মাঝে ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করত। তাদের আশ্বস্ত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। কারণ অনিশ্চয়তার কারণে শ্রমিকরা প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল। তাছাড়া ভাষার প্রতিবন্ধকতা সবসময় ছিল। বেশিরভাগ শ্রমিকই ইংরেজি বলতে পারে না। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল বাংলাদেশের’।
‘পিপিই এবং গগলস পরিহিত অবস্থায় আমাদের ভিনগ্রহের বাসিন্দা মনে হয়েছিল। মুখোশ এবং চশমার চাপে কথা বলতে গিয়ে প্রচণ্ড কষ্ট হত। পরবর্তীকালে আমিও নিজের ছবি দেখে নিজেকে চিনতে পারছিলাম না’।
ডা. মুনতাসির বাঙালি শ্রমিকদের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। তাদের মাতৃভাষায় কথা বলার সাথে সাথে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখতে পান। তিনি বলেন, ‘যখনই আমি বাংলায় কথা বলতে শুরু করি, তাদের চোখেমুখে আনন্দ দেখা যেত’। তিনি সবাইকে আশার আলো দেখিয়েছিলেন।
সিঙ্গাপুর থেকে ওমর ফারুকী শিপন