জীবন জীবিকার তাগিদে আপনজন ছেড়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি দেয়া বাংলাদেশিরা ভালো নেই। করোনা ভাইরাসের কারণে তাদের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকে বেতন পাচ্ছেন না। অনেকেই শুধু ভাত দিয়ে ইফতারি করছেন।

আবার কেউ কেউ অযথা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন। সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়েছেন অবৈধভাবে বসবাসকারীরা। সেখানে অন্যান্য দেশের হাই কমিশন সাহায্য করলেও বাংলাদেশের হাহকমিশন নামমাত্র সহযোগিতা করছে বলে তাদের অভিযোগ।

chardike-ad

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় প্রায় ৬ লাখ বৈধ বাংলাদেশি কাজ করেন। এছাড়া আরও কয়েক লাখ অবৈধ বাংলাদেশি আছেন। করোনা ভাইরাসের কারণে দেশটিতে লকডাউন চলায় এই রমজানে তারা খেয়ে না খেয়ে দিনযাপন করছেন। অন্যদিকে দেশে থাকা পরিবারের কাছেও টাকা পাঠাতে পারছেন না। এ কারণে দেশে পরিবারও অথৈ সাগরে পড়েছে। লকডাউন উঠে গেলে অনেককে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে বলেও মালিকপক্ষ ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। তবে কাজ বন্ধ থাকলেও কিছু কোম্পানি বেতন দিচ্ছে বলে জানা গেছে।

মেহেরপুর জেলা থেকে মালয়েশিয়া যাওয়া বিপ্লব বলেন, দুমাস ধরে আমরা বসে আছি। কোনো টাকা-পয়সা নেই। আমরা এক রুমে সাতজন মানুষ আটকা পড়ে গেছি। সাত জনের জন্য মাত্র এক হাজার রিঙ্গিত দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই টাকা দিয়ে সাতজন কত দিন চলতে পারে? আমরা রমজান মাসে শুধু ভাত দিয়ে ইফতার করি।

তারা যে প্রতিষ্ঠানের কাজ করেন তার মালিককে বেতন দেয়ার কথা বললে তাদের বলা হয়, এখন লকডাউন চলছে, টাকা দিতে পারব না। মঙ্গলবার ২৮ এপ্রিল টাকা দেয়ার কথা ছিল, দেয়নি। বিপ্লব আরও বলেন, টাকার জন্য বেশি জোর করতে গেলে আমাদের হুমকি দেয়- পুলিশে দেবে। কারণ, মালয়েশিয়ায় আমরা অবৈধ। আইনগতভাবে আমরা কিছু করতে পারি না। সরকার আমাদের একটু দেখুন।’’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে যাওয়া মোশতাক সনি বলেন, ‘‘আমার ছোট ভাই বাসা থেকে বের হয়ে দোকানে গেছিল পানি আনতে। সেখানে পুলিশ পাসপোর্ট চেক করে, সবকিছু ঠিক থাকার পরও পুলিশ ওকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। সেখানে কোনো মানুষের জমায়েতও ছিল না, মুখে মাস্কও ছিল। তারপরও তাকে ধরে নিয়ে যায়। জেলে নিয়ে ১৪ দিন রাখার পরে কোর্টে তোলে। তারপর ছাড়া পায়। এর মধ্যে ওকে না দেয়া হযেছে কারো সাথে যোগাযোগ করতে, না দেয়া হয়েছে কাউকে একটা কল করতে ।’’

জামালপুর থেকে যাওয়া কফিল উদ্দিন বলেন, ‘‘মালয়েশিয়ায় অবস্থিত হাইকমিশন সাহায্যের নামে নাটক করছে। তারা নাম তালিকা নিলেও সবাইকে সাহায্য করেনি। এরা সাহায্য করার চেয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে দেয় বেশি।’’

সেখানে নেত্রকোনা থেকে যাওয়া মাসুম বলেন, ‘‘আমরা মালয়েশিয়ার পেনাং-এ ৫০০০ শ্রমিক একটি কোম্পানিতে আছি। এর মধ্যে ২শ জন বাংলাদেশি। মালিক ঘোষণা দিয়েছে লকডাউনের পর সবাইকে দেশে পাঠিয়ে দেবে। এজন্য খুব চিন্তায় আছি।’’

চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া মনির হোসেন গাজী বলেন, ‘‘বেতন তো দূরের কথা, রুম ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল নিজের দিতে হচ্ছে। আমরা যারা আউটসোর্স হিসেবে আছি, তাদের অবস্থা খুবই করুণ।’’

বগুড়ার নাজমুল আলম বলেন, ‘‘বেসিক স্যালারি দেয়নি। মার্চ মাসের ১৫ দিনের বেতন পেয়েছি আমরা। কিন্তু সরকার বেসিক দেয়ার কথা বলছিল, আমাদের কোম্পানি দেয়নি। মনে হচ্ছে এপ্রিল মাসের এক টাকাও পাবো না।’’

মেহেরপুরের নাহিদ জামান বলেন, আমি তিনমাস বেতন পাইনি। পেনং এ ছোটভাই আছে তার কাছে থেকে টাকা এনে খাবার খরচ বহন করছি। যে সমস্ত বাংলা কপালা (কোম্পানির ফোরম্যান) আছে এরা বেশি খারাপ, মালিক টাকা দিলেও কপালা বেতন দেরিতে দেয়।৪৪ হাজার টাকা বেতন পাওনা। এজন্য অনেকেই দেশ থেকে বিকাশে টাকা এনে খাবারের টাকা দিচ্ছেন।’’

কক্সবাজারের জয়নাল আবেদীন দেড় বছর ধরে সেখানে আছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমরা অবৈধ শ্রমিক একটা ফাইভ স্টার হোটেলে কাজ করতাম। করোনা ভাইরাসের কারণে হোটেলটি বন্ধ হয়েছে অনেকদিন হলো। আমরা এখনো বেতন পাইনি। আমরা যে এজেন্টের মাধ্যমে হোটেলে কাজ করতাম সে এজেন্টকে ফোন দিলে ফোন রিসিভ করে না। আমাদের খাওয়া-দাওয়া সবকিছু নিয়ে একটা অনেক বড় বিপদের মধ্যে আছি।

রহমান মতিউর নামে একজন জানান, ‘‘বর্তমানে পরিস্থিতি খুবই খারাপ মালয়েশিয়ান প্রবাসীদের। গত ১৮ মার্চ থেকে কাজ বন্ধ। জানি না কবে থেকে আবার কাজ চালু হয়।’’

রাকিব এন রানা বলেন, ‘বেশিরভাগ কোম্পানিই বেতন দিচ্ছেনা।সবচেয়ে কষ্টকর অবস্থায় আছে কনস্ট্রাকশনের লোকেরা।’

মাহফুজুর রাহমান বলেন, ‘‘পেনাং-এ আছি আমরা। নির্মাণ খাতে কাজ করছি আমরা। ভিসা লাগাই এজেন্ট দিয়ে। কাজ করি অন্য কোম্পানির। গত মাস থেকে কাজ বন্ধ। খাবারের টাকাও নেই।’’

মো. আজহার বলেন, ‘‘বেতন দেবে না। তবে ২৫০ রিঙ্গিত খাবারের জন্য দিয়েছে।’’

তবে মালয়েশিয়া মেঘায় অবস্থান করা চাঁপাইনবাবগঞ্জ এর শাহ্ আলম বলেন, ‘‘মালয়েশিয়ায় দুই বছর পাঁচ মাস হলো আছি। আমি কোজাতো কিজায় কোম্পানিতে চাকরি করি। কাজ বন্ধ থাকলেও মালিকপক্ষ বেতন দিচ্ছে।’’

লক্ষ্মীপুরের মো. মইন উদ্দিন পাটোয়ারি বলেন, ‘‘আমাদের কোম্পানি গত মার্চ মাসের বেতনই পুরা দেয়নি। যত দিন কাজ করছি ততদিনের টাকা দিয়েছে। কিন্তু সরকার থেকে ঘোষণা ছিল পুরা বেসিক দিতে হবে। আমরা প্রবাসীরা আসলেই অসহায়। কারণ, আমাদের দূতাবাস ভালো না। তারা খোঁজ নেয় না।’’

প্রসঙ্গত, সর্বশেষ খবর অনুযায়ী মালেশিয়াতে সর্বমোট ৫৮৫১ জন আক্রান্ত হয়েছেন।দেশটিতে মোট মৃতের সংখ্যা ১০০ জন।