চেনা পৃথিবী আজ বড় অচেনা। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে বদলে গেছে পৃথিবী। বদলায়নি কেবল মানুষ। পত্রিকায় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গরিবের চাল চুরির যে মহোৎসবের চিত্র উঠে আসছে তা রীতিমতো ভয়াবহ। নিজের নিঃশ্বাসকে যেখানে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, সেখানে মানুষ কী করে অসহায় গরিব মানুষের ত্রাণ চুরি করে? অথচ দুর্বৃত্তরা জোট বেঁধে নেমে পড়েছে নগরে-বন্দরে, গ্রামেগঞ্জে।
কিশোরগঞ্জের ভৈরব খাদ্য গুদামের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছে। তদন্ত কমিটির ভাষ্যমতে, ৮১ টন চাল ও ১ লাখ ৭৬ হাজার ৪২৬টি নতুন খালি বস্তার হদিস পাওয়া যায়নি। সেগুলো গুদামে মজুদ নেই। সরকারি হিসাবে এর মূল্য দেড় কোটি টাকারও বেশি। করোনার বিভীষিকায় যখন জীবন বিপন্ন সেখানে চাল চুরির খবর দেখে অস্বস্তিবোধ আরো বেড়ে গেছে। বাড়ছে লাশের মিছিল। জীবন মৃত্যুর এ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও চাল চোরদের চৌর্যবৃত্তি থামেনি। লকডাউনের কারণে এক একটি দিন কয়েক বছর মনে হচ্ছে। ঘড়ির কাটা যেন কিছুতেই ঘুরছে না। এ পরিস্থিতিতে অদৃশ্য শত্রু র মোকাবেলায় পুরো বিশ্বের মানুষ যখন ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি করছে তখন বাংলাদেশে চাল চুরির খবর পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হচ্ছে। এর চেয়ে লজ্জার বিষয় একটা জাতির জন্য আর কী হতে পারে!
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের আগ্রাসী থাবায় জীবন আজ বিপন্ন। কোথাও যেন এতটুকু জায়গা নেই, যেখানে দাঁড়িয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নেওয়া যায়। সবর্ত্র হাহাকার আর কান্নার আওয়াজ আকাশে-বাতাশে ভাসছে। আশার আলোর দেখা মেলছে না। বাংলাদেশে চলছে লকডাউন। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করছে দেশের মানুষ। কী গ্রাম কী শহর সর্বত্র একই অবস্থা বিরাজমান। এই লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। বন্ধ হয়ে আছে কলকারখানা। জাতির এই ক্রান্তিকালে যারা ত্রাণের চাল চুরি করছে, তারা কারা? প্রশাসন কি তা জানে না? নিশ্চয় জানে। যে সব জনপ্রতিনিধি চুরির দায়ে অভিযুক্ত হচ্ছে তারা কি জনগণের ভোটে নির্বাচিত? এই সরকার বিরোধীমতের লোকদের উপর যেভাবে নির্যাতনের স্টিমরোলার প্রয়োগ করেছে, তার ছিটেফোটাও যদি অসৎ দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে করতো তাহলে সম্রাট-পাপিয়াদের জন্ম হতো না।
১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কথা এখনো মরুব্বীদের মুখে শোনা যায়। কিন্তু সে দুর্ভিক্ষ কেন হয়েছিল? এটা পর্যালোচনা করতে গিয়ে কিছু মানুষ মত দিয়েছেন যে, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ছিল মানবসৃষ্ট। সত্তর দশকের শুরুতে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছিল। আর সে কারণে প্রতিটি দেশ তার নিজ নিজ খাদ্য মজুদের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের কিছু মন্ত্রী-এমপি ও সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, খাদ্যশস্য মজুদের অব্যবস্থাপনা, খাদ্যশস্য আমদানির ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে হয়েছিল বাংলাদেশকে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে প্রায় ২৭ হাজার মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। তবে বেসরকারি হিসেব মতে, এক লাখ বা তারও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল।
দেশব্যাপী ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে লুটপাট, দুর্নীতি ও অনিয়মের তেলসমাতি কারবার চলছে। বস্তা বস্তা চাল জব্দ, জড়িতদের আটক, জরিমানা, মামলা হলেও থামছে না চাল চুরির ঘটনা। ত্রাণ বণ্টনের দায়িত্বে ন্যস্ত যারা তাদের কেউ কেউ ভক্ষকের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হচ্ছে। চাল চুরির ঘটনা লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। তবু কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলাম।
একটি সহযোগী পত্রিকা রিপোর্ট করেছে যে, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১৩৬১ বস্তা চাল জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২২৬ বস্তা, জয়পুরহাটে ৮৭৫ বস্তা, বগুড়ায় ১৬৮ বস্তা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩১ বস্তা, মাদারীপুরে ২৬ বস্তা, খাগড়াছড়িতে ২৮ বস্তা ও ভোলায় ৭ বস্তা চাল উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গাতেই চাল বিতরণের অনিয়মের খবর পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হয়েছে। জামালপুরে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতার গুদাম থেকে ৫০৪ বস্তা চাল উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় পুলিশ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতিসহ ২ জনকে গ্রেফতার করেছে। জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলার গোপীনাথপুর বাজারের আওয়ামী লীগ নেতার একটি গুদাম থেকে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের ৬২৫ মণ চাল উদ্ধার করেছে র্যাব। এ ঘটনায় গোপীনাথপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আল ইসরাইল জুবেলকে গ্রেপ্তার করা হয়। পটুয়াখালীতে জেলেদের জন্য বরাদ্দ ভিজিএফের চাল চুরির ঘটনায় সদর উপজেলার কমলাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনির হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ঝালকাঠি সদর উপজেলার বাসন্ডা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা মেম্বারস ফোরামের সভাপতি মো. মনিরুজ্জামান মনিরের বাসা থেকে ত্রাণের আড়াই টন চাল জব্দ করেছে জেলা প্রশাসন। বরগুনায় জেলেদের জন্য বরাদ্দকৃত ৪৪ মেট্রিক টন চালের মধ্যে ২৭ মেট্রিক টন চাল আত্মসাৎ করার অভিযোগে এক ইউপি চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
ব্র্যাকের এক জরিপে বলা হয়েছে, দেশের ১৪ শতাংশের ঘর খাবার শূন্য হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতির কারণে দেশে চরম দারিদ্র্যের হার আগের তুলনায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে। সরকার যে পরিমাণ চাল বিতরণ করছে তা পর্যাপ্ত নয়। অথচ মরার উপর খাড়ার ঘা হিসাবে চাল চুরির ঘটনা বেড়েই চলছে। করোনায় ভয় সবাইকে তাড়িয়ে বেড়ালেও কিছু মানুষরূপী অমানুষকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে না। তারা মানুষ কি না? তা রক্ত পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন। তা না হলে মানুষ কি পারে এমন দুর্দিনে চাল চুরির হিম্মত দেখাতে?
স্বাধীনতার ৪৯ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ চোর মুক্ত হয়নি। সেজন্য তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আক্ষেপ করে বলেছিলেন, সবাই পায় সোনার খনি আমি পেয়েছি চোরের খনি। তাঁর শাসনামল থেকেই চোর, দুর্নীতিবাজরা সক্রিয় ছিল। যার ক্রমধারা এখনো চলছে। যে দেশে বালিশ দুর্নীতি, পর্দা দুর্নীতি, ব্যাংক লুটপাট হয় সেদেশে ত্রাণের চাল চুরি ঠেকাবে কে? সরষের ভেতর যদি ভূত থাকে ওই ভূত যেমন কেউ সরাতে পারেনি, তেমনি রাষ্ট্রের ভেতর যখন আইনের সুশাসনের ঘাটতি দেখা দেয় তখন সেখানে হাজারো অপরাধ উপসর্গ হিসেবে দেখা দেয়। তখন কারো কথায় কাজ হয় না। কথায় আছে, তো চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী। তারা করোনাও মানে না মানবতাও মানে না।
লেখক: মো. তোফাজ্জল বিন আমীন