বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই মসজিদ আছে। এমনকি কোনো কোনো গ্রামে একাধিক মসজিদও আছে। দেশে বর্তমানে কতটি মসজিদ আছে তা এখনও জানা সম্ভব হয়নি। ঢাকাকে বলা হয় মসজিদের শহর। মসজিদের পরিসংখ্যান সম্পর্কে গুগলে ২০১৮ সালের পর কোনো আপডেট তথ্য নেই। ২০১৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ অধিবেশনে সরকারি দলের সংসদ সদস্য শেখ মো. নুরুল হকের প্রশ্নের উত্তরে তৎকালীন ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমার যে তথ্য দেন, সে অনুসারে দেশে মসজিদের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার ৯৯টি।
গুগুলে কোনো আপডেট না পেলেও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সচিব কাজী নুরুল ইসলামের দেয়া তথ্য মতে দেশে বর্তমানে মসজিদের সংখ্যা ৩ লাখেরও বেশি। তারপরও মসজিদের প্রকৃত সংখ্যা অজানাই রয়ে গেল। তবে মসজিদের তথ্য জানতে চাওয়া সচিব কাজী নুরুল ইসলামের বিনয়ী আচরণ আমাকে মুগ্ধ করেছে।
বর্তমানে দেশে সরকারি অর্থায়নে আরও ৫৬০টি মসজিদ কাম সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্প নির্মাণাধীন। এখন আসি আসল কথায়- এই মূহূর্তে বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী চলছে লকডাউন। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এ পরিস্থিতিতে দরজায় কড়া নাড়ছে রহমতের বার্তাবাহী ইবাদতের মাস রমজান। রমজানের মূল ইবাদত হচ্ছে রোজা পালন। যে রোজার পুরস্কার দেবেন আলাহ নিজেই মর্মে ঘোষণা করেছেন। মাসব্যাপী রোজা পালন মুসলমানদের জন্য এক মহাপবিত্র ইবাদত হিসেবে বিবেচিত।
সিয়াম বা রোজার পাশাপাশি কিয়াম তথা নামাজের মাসও রমজান। এ মাসে মুসলিম উম্মাহ কুরআনের লম্বা তেলাওয়াতে তারাবিহ আদায় করেন। কুরআনের সম্মানিত হাফেজরা এ নামাজের ইমামতি করেন। দেশের অধিকাংশ মসজিদেই হাফেজে কুরআন এ তারাবিহ পড়ান।
আজকাল শুধু শহরেই নয়, গ্রামের মসজিদগুলোতে হাফেজরা তারাবিহ নামাজে পুরো কুরআন তেলাওয়াত সম্পন্ন করেন। ‘খতম তারাবিহ’ খ্যাত এ নামাজে দেশের প্রায় ১০ লাখ হাফেজে কুরআন নামাজ পড়ান। যদিও কী পরিমাণ হাফেজে কুরআন রয়েছে তা নির্ণয় করার জন্য কোনো সংস্থা আপাতত দেশে নেই। হাফেজে কুরআনের সংখ্যা দেশে যাই হোক না কেন, এসব হাফেজ সারা বছরই কুরআন চর্চায় নিয়োজিত থাকেন। রমজান মাসে তারা তাদের সে চেষ্টা-সাধনার প্রয়োগ ঘটান। জ্বালিয়ে নেন তাদের ইয়াদ তথা আতস্থ থাকার বিষয়টি।
করোনাভাইরাসের কারণে এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। দিন দিনি করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যে তারাবিহ স্থগিত ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে দেশের জনগণকে ঘরে তারাবিহ আদায়ের কথা জানিয়েছেন মর্মে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং এটি সুস্পষ্ট যে, এবারের তারাবিহ মসজিদে বড় জামাআত অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই।
গত ৬ এপ্রিল ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় অধিশাখা কর্তৃক ইস্যুকৃত পত্র নং ১৬.০০.০০০০.০০১.২১.০০৩, ২০২০-১৪৮ এর ৪/১ ধারা অনুসারে পাঞ্জেগানা নামাজে ইমাম মুয়াজ্জিনসহ ৫ জন আর জুমআয় ইমাম-মুয়াজ্জিনসহ সর্বাধিক ১০ জন মুসল্লি জামাআতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন মর্মে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
সরকার ও ইসলামি ফাউন্ডেশন ইতোমধ্যেই মুসল্লিদের নিজ নিজ ঘরে তারাবিহ নামাজ আদায় করার জন্য অনুরোধ করেছেন বা নির্দেশনা জারি করেছেন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে করোনারোধ কল্পে এ সিদ্ধান্ত অত্যাবশ্যকীয় ছিল। আশা করি দেশবাসী বিশেষ করে গ্রামের মুসল্লিরা তা মেনে চলবেন।
করোনাভাইরাসের চিকিৎসার কোনো মেডিসিন এখনও পৃথিবীর কোনো বিজ্ঞানী আবিষ্কার করতে পারেননি। করোনা চিকিৎসায় বিশ্ববাসীর বহুল প্রত্যাশিত ‘ভ্যাকসিন’ আক্রান্ত মানুষের জীবন রক্ষার্থে কবে বাজারে আসবে তাও কেউ জানে না। করোনা গোটা বিশ্বব্যবস্থাকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতি বিশ্ববাসীর কল্পনায়ও ছিল না। বিশ্ববাসী এখন প্রতিদিন করোনামুক্ত সকাল দেখার আশায় ঘুমাতে যায়।
মুসলিম উম্মাহ এবার রমজানের রাতের ইবাদত নামাজে ‘খতম তারাবিহ’-এর আমেজ ও স্বাদ থেকে যেমন বঞ্চিত থাকবে তেমনি রাজধানীবাসী এবার রমজানে প্রথম বারের মতো পুরান ঢাকা ও বেইলি রোডের বাহারি ইফতারির স্বাধ থেকেও হবে বঞ্চিত।
রমজান মাসে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহর এমনকি গ্রামাঞ্চলের অনেক মসজিদে গরিব-অসহায় খেটে খাওয়া মানুষের জন্য ইফতারের আয়োজন করে। এবার হয়ত তাও আর সম্ভব হবে না। বঞ্চিত হবে সমাজের অসচ্ছল খেটে খাওয়া মানুষগুলো।
রোজার মাসে বাংলাদেশসহ বিশ্বের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা ও মদিনায় গমন করেন। কিন্তু এবার করোনার কারণে মানুষ কাবাঘর তাওয়াফ করছে না, এদৃশ্য বিশ্ব মুসলিমদের জন্য বড় হৃদয়বিদারক ঘটনা। মদিনা মসজিদে নববিতে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য বিশ্ববাসী একসঙ্গে বসে ইফতার করতে পারবে না তা কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবেনি। সেটাই আজ ঘটতে চলেছে।
কারণ করোনাভাইরাস গোটা বিশ্বব্যবস্থাকে তছনছ করে দিয়েছে। কবে তা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে এই মুহুর্তে কেউই তা বলতে পারছে না।
এবার আসি আসল কথায়, যে কারণে এ লেখার অবতারণা- দেশব্যাপী কমবেশি প্রায় ১০ লাখেরও বেশি কুরআনে হাফেজ বড় জামাআতে তারাবিহ পড়ানো থেকে বঞ্চিত হবে। কারণ রমজানই তাদের কুরআন চর্চার মূল মাস। তারাবিহ অনুষ্ঠিত না হলে তাদের মাঝে কুরআন তেলাওয়াতের সে চর্চায় প্রাণ ফিরে আসবে না। তাছাড়া তারাবিহ উপলক্ষে এ দেশের অনেক হাফেজে কুরআন মুসল্লিদের থেকে পেয়ে থাকেন হৃদ্যতা, আতিথেয়তা ও উপঢৌকন, যা তাদের ঈদের আনন্দ আরো বাড়িয়ে দেয়। সে রকম কিছু হওয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনাও এবার নেই।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সমজিদে খতম তারাবিহর জামাআত অনুষ্ঠিত হওয়া তো দূরের কথা কোনো মুসল্লিই উপস্থিত হতে পারবে না। মহামারি করোনার কারণে কোনো মুসল্লির উপস্থিত হওয়াও উচিত হবে না। এ বিষয়ে মসজিদ কমিটিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
শহরে কোনো সমস্যা না হলেও গ্রামের অতি উৎসাহী কিছু মানুষ যাতে তারাবিহ নামাজ আদায়ে বড় কোনো জামাআত করতে না পারে সে বিষয়টি মসজিদের ইমাম, মসজিদ কমিটি ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনকেই জনসচেতনা সৃষ্টিতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এখন দেশের ১০ লক্ষাধিক হাফেজে কুরআনের ব্যাপারে সরকার কিংবা মসজিদ কমিটি কী মানবিক হবেন? তা না হলে বহুসংখ্যক হাফেজের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের সদস্যদের রোজা ও ঈদ অনেকটাই হয়ে উঠবে কষ্টদায়ক।
মসজিদ কমিটি রমজান শুরু হওয়ার আগে থেকেই নিয়োগকৃত হাফেজদের সংশ্লিষ্ট মসজিদের পক্ষ থেকে নিয়োগ করতে পারেন। যেহেতু ৫-১০ জন মুসল্লি সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারবেন, সেহেতু একদিকে যেমন সারাদেশের লাখো মসজিদে কুরআন তেলাওয়াত হলো আবার খতম তারাবিহও অব্যাহত থাকলো। হাফেজে কুরআনদের চর্চার পাশাপাশি যৎসামান্য আর্থিক উপহারেরও ব্যবস্থা হলো।
আবার এমনটিও করা যেতে পারে যে, ‘স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কারণে হাফেজদের মসজিদে না এনে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে মসজিদ কমিটি কর্তৃক হাফেজদের নিয়োগ দিয়ে তাদের মসজিদে না এনে নিজ নিজ বাসায় রেখে কুরআন খতমের লক্ষ্যে তারাবিহ নামাজ আদায় করার জন্য দায়িত্বও প্রদান করা যেতে পারে।
মহামারি করোনা মসজিদে খতম তারাবিহ ইমাম হিসেবে হাফেজদের নিয়োগ ও সম্মানী একেবারেই অনিশ্চিত করে তুলেছে। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের পরিবারের সদস্যদের রোজা ও ঈদ উদযাপন এই সম্মানির ওপর নির্ভর করে। তাই দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় হাফেজদের নিয়োগবঞ্চিত না করে আলোচনার মাধ্যমে তাদের নিয়োগের বিষয়টি স্বাস্থ্য প্রটোকল অনুযায়ী করা যায় কিনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে।
এক্ষেত্রে তাদের সম্মানী এবারের মত কমবেশি হতে পারে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন তাদের জেলা অফিসের মাধ্যমে প্রকৃত হাফেজদের তালিকাও তৈরি করে তাদের জন্য মসজিদভিত্তিক থোক বরাদ্দ প্রদান করে এই সমস্যা সমাধান করতে পারে।
সমাজের সম্পদশালী ব্যক্তিরাও কুরআন নাজিলের এ মাসে কুরআন চর্চা চালু রাখার স্বার্থে এগিয়ে আসতে পারেন। অন্যদিকে সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত মসজিদে খতম তারাবিহর জন্য আগের মতো হাফেজদের নিয়োগ করে সাময়িক ভাবে এ সমস্যা মোকাবেলা করা যেতে পারে। আশা করি মসজিদ কমিটি ও সরকার উভয়েই সহানুভূতির সঙ্গে বিষয়টি বিবেচনা করবেন। অন্যথায় দেশের হাফেজরা এক অনিশ্চিত সংকটে পতিত হবেন।
লেখক: প্রফেসর ড. মোহা. হাছানাত আলী
প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: drhasnat77@gmail.com