রোমানিয়া শব্দটি এসেছে ল্যাটিন রোমানাস থেকে যার অর্থ ‘সিটিজেনস অব রোম’ বা রোমের অধিবাসী। ১৮৭৭ সালে রোমানিয়া অটোমান শাসকদের হাত থেকে মুক্ত হয় এবং ১৮৮১ সালে ‘কিংডম অব রোমানিয়া’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
২০১৭ সালে করা এক জরিপে দেখা গেছে, রোমানিয়ার জনসংখ্যা ১৯.৭১ মিলিয়নের কাছাকাছি। এ জনসংখ্যার শতকরা একানব্বই ভাগের মতো মানুষ খ্রিস্টান (মূলতঃ অর্থোডক্স খ্রিস্টান) ধর্মে বিশ্বাসী। রোমানিয়ার বেশিরভাগ মানুষই রোমানিয়ান নামক Ethnic গোষ্ঠীর সদস্য।
তবে, দেশটিতে হাঙ্গেরিয়ান, জার্মান, রোমা, ইউক্রেনিয়ান এ সকল Ethnic গোষ্ঠীর মানুষও রয়েছেন। দেশটির শহরাঞ্চলে বসবাস করা মানুষেরা সাধারণত পাশ্চাত্য ভাবধারার পোশাক পরিধান করে থাকেন। তবে গ্রামাঞ্চলের দিকে বসবাস করা মানুষেরা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করতে বেশি ভালোবাসে। রোমানিয়াতে মেয়েদের চুল দেখে বলে দেওয়া যায় যে সে কী বিবাহিত না কি অবিবাহিত। অবিবাহিত মেয়েরা চুল খোলা রাখতে পছন্দ করে এবং সাধারণত চুলে বেণী গেঁথে থাকে। আর বিবাহিত নারীরা মারামা নামক একধরনের কাপড় দিয়ে চুল ঢেকে রাখে।
রোমানিয়ার জাতীয় পতাকায় নীল, হলুদ এবং লাল এ তিনটি ভিন্ন রঙের সংমিশ্রণ রয়েছে যা ট্রান্সসিল্ভানিয়া, মলদাভিয়া এবং ওয়ালাসিয়া-এ তিনটি ভিন্ন স্থানকে প্রতিনিধিত্ব করে। এ তিনটি স্থান দেশটির ঐতিহাসিক একতার পরিচয় বহন করে।
রোমানিয়ার রাজধানী এবং বৃহত্তম নগরের নাম বুখারেস্ট যা দেশটির শিল্প, সাহিত্য এবং বাণিজ্যসহ যাবতীয় প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে জনসংখ্যার বিবেচনায় বুখারেস্ট ষষ্ঠ বৃহত্তম শহর। রোমানিয়ার জাতীয় সংসদ যা রোমানিয়ার স্থানীয় ভাষায় পার্লামেন্টুল রোমানিয়েই নামে পরিচিত এ বুখারেস্টে অবস্থিত।
এ পার্লামেন্ট ভবনটি সারা পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম নির্মাণ। যার আগে কেবল মাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত পেন্টাগনের বিল্ডিং রয়েছে। রোমানিয়ার ন্যাশনাল পার্লামেন্টকে পৃথিবীতে এ যাবৎ কাল পর্যন্ত নির্মিত সবচেয়ে ভারী নির্মাণ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
আয়তনের দিক থেকে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পার্লামেন্ট। অসাধারণ নির্মাণশৈলীর স্থাপত্যকলা, শহরের গঠন এবং ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং এর সাথে বিদ্যমান সাহিত্য এবং চিত্রকলার অপরূপ মেলবন্ধনের কারণে বুখারেস্টকে পূর্ব ইউরোপের প্যারিস নামেও ডাকা হয়।
প্রায় ৯২,০৪৫.৬ বর্গমাইল জায়গাজুড়ে থাকা রোমানিয়া দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের সবচেয়ে বড় দেশ এবং আয়তনে এটি ইউরোপ মহাদেশের দ্বাদশ বৃহত্তম রাষ্ট্র। যেখানে দেশটির দক্ষিণে বুলগেরিয়া, পশ্চিমে সার্বিয়া এবং হাঙ্গেরি আর পূর্বে ইউক্রেন এবং রিপাবলিক অব মলদোভা অবস্থিত।
এছাড়াও দেশটির দক্ষিণ পূর্বের প্রায় ২৪৫ কিলোমিটার রেখা বরাবর কৃষ্ণসাগর বা ব্ল্যাক সি এর উপকূল রয়েছে। ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী ড্যানিউব অস্ট্রিয়া, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, রিপাবলিক অব মলদোভা এবং ইউক্রেন-এই নয়টি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রোমানিয়াতে এসে করে কৃষ্ণসাগরের কাছে ড্যানিউব ডেল্টা নামক বদ্বীপ তৈরি করেছে।
এ বদ্বীপটি পৃথিবীর মধ্যে বিভিন্ন ধরণের জৈব বৈচিত্র্যসম্পন্ন এবং স্থিতিশীল জলাভূমির মধ্যে একটি। এখানকার আপুসেনি পর্বতমালার নিম্নাংশে অবস্থিত স্কারিশোয়ারা নামক হিমবাহটি ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভূ-গর্ভস্থ হিমবাহ যা আনুমানিক ৩,৫০০ বছরের পুরনো বলে মনে করা হয়।
কার্পাথিয়ান পর্বতমালার পূর্ব ও দক্ষিণাংশ রোমানিয়ার মধ্যভাগে অবস্থিত। ইউরোপ মহাদেশের প্রায় সবচেয়ে বেশি অঞ্চলজুড়ে বিরাজমান অনিয়মিত বন-জঙ্গলগুলো একমাত্র এ রোমানিয়াতে পড়েছে। এসকল বন-জঙ্গল বিভিন্ন জীব-বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। ব্রাউন বিয়ার বা বাদামী ভাল্লুকের জন্য রোমানিয়া বিখ্যাত এবং রাশিয়ার অংশটুকু বাদ দিলে ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্রাউন বিয়ার রোমানিয়াতেই পাওয়া যায়।
দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত্ন পর্যটন কেন্দ্রগুলো বর্তমানে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে আর এ কারণে তাই পর্যটন শিল্প বা ট্যুরিজম বর্তমানে রোমানিয়ার অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আঙুর, আপেল, সরষে এবং বিভিন্ন সবজি থেকে প্রস্তুতকৃত তেল থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন ধরণের ফার্মাসিটিকাল, ক্যামিকাল, লৌহ এবং ইস্পাত শিল্প, মেশিনারি শিল্প, বস্ত্রশিল্প এবং মোটর গাড়ী তৈরির কারখানার মতো ভারী ভারী শিল্প রোমানিয়ার অর্থনীতিকে করেছে অত্যন্ত বেগবান।
প্রকৃতি থেকে পাওয়া প্রচুর পরিমাণে খণিজ তেল সম্পদ এবং পৃথিবীতে জমা থাকা স্বর্ণের এক বিশাল ভাণ্ডার রোমানিয়াতে রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রোমানিয়া এ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ওয়াইন প্রস্তুতকারক দেশগুলোর মধ্যে একটি। বিখ্যাত মোটরগাড়ি প্রস্তুত কোম্পানি ‘ডাসিয়া’ এর সদর দফতর রোমানিয়ার মিওভেনিতে।
রোমানিয়ার জাতীয় মুদ্রার নাম রোমানিয়ান লিউ। লিউ শব্দের অর্থ হচ্ছে সিংহ। এক রোমানিয়ান লিউ = ০.২১ ইউরো যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় উনিশ টাকার সমতুল্য। পূর্ব ইউরোপে প্রচলিত মুদ্রাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে রোমানিয়ান লিউকে সবচেয়ে স্থিতিশীল মুদ্রা হিসেবে গণ্য করা হয়। পলিমারের তৈরি রোমানিয়ান লিউয়ের প্রত্যকটি নোটই আলাদা শিল্পকর্ম।
ইউরোপ মহাদেশের অন্যান্য দেশগুলোর (যেমন- জার্মানি, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইজ্যারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড, ইতালি, স্পেন, বেলজিয়াম) থেকে রোমানিয়া তুলনামূলকভাবে কম স্বচ্ছল অর্থনীতির দেশ।
আর এ কারণে এ দেশের জনসাধারণের জীবন-যাত্রার মানও ইউরোপের অন্যান্য দেশের মানুষের চাইতে নিম্ন। তবে রোমানিয়ার মানুষেরা খুবই পরিশ্রমী এবং এ কারণেই দেশটি খুব দ্রুত উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এ সকল সাধারণ এবং পরিশ্রমী জনগোষ্ঠীর কারণে দেশটি নানা প্রতিবন্ধকতা স্বত্বেও একতা বজায় রাখতে পেরেছে।
বর্তমানে রোমানিয়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর মতো প্রতিপত্তিশালী সংস্থাগুলোর সদস্য এবং খুব শীঘ্রই বুলগেরিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার সাথে রোমানিয়া সেঞ্জেনভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর তালিকায় যোগ হতে যাচ্ছে।
রোমানিয়ার মানুষ তাদের বন্ধুসুলভ আচরণ এবং অতিথি আপ্যায়নের জন্য বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে খুবই সমাদৃত। বলা হয়ে থাকে যে বিদেশি পর্যটক যারা এ দেশে বেড়াতে আসেন তাদের কেউ যদি স্থানীয় ভাষায় কথা বলেন তাহলে সেখানকার মানুষেরা না কি খুবই খুশি হন। রোমানিয়ার মানুষ অতিথিদের বিভিন্ন খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করতে ভালোবাসে।
রোমানিয়ার আধিকারিক ভাষা রোমানিয়ান এবং রোমানিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ ইতালিয়ান কিংবা ফ্রেঞ্চদের ভাষার সাথে অনেকটা সাদৃশ্যপূর্ণ। পূর্ব ইউরোপের মধ্যে রোমানিয়ান একমাত্র ল্যাঙ্গুয়েজ যেটি ল্যাটিন ল্যাঙ্গুয়েজ ফ্যামিলির অন্তর্ভুক্ত যার চারপাশ স্লাভিক/ইউরালিক ল্যাঙ্গুয়েজের ফ্যামিলির জাতিগোষ্ঠী দিয়ে পরিবেষ্টিত।
অর্থাৎ রোমানিয়ান পূর্ব ইউরোপের মধ্যে একমাত্র রোমান্স ল্যাঙ্গুয়েজ। দেশটির প্রায় ৯২ শতাংশ মানুষ এ ভাষায় কথা বলে থাকে। ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স কিংবা পর্তুগাল থেকে হাজারো মাইল দূরে অবস্থিত একটি দেশে কীভাবে ল্যাটিন ভাষাগোষ্ঠীর ভাষা প্রবেশ করলো সেটা নিয়ে নেহাৎ গবেষণা হয় নি কম তবে এখনও এর প্রকৃত কারণ কেউ বের করতেও পারেনি।
তবে ধারণা করা হয় যে পূর্ব রোম সাম্রাজ্য তথা বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের পতন ঘটলেও বাইজেনটাইন রাজার অধীনে কাজ করা সৈনিকদের এক অংশ সুউচ্চ কার্পেথিয়ান পর্বতমালার কারণে এ অঞ্চলটিকে তাঁদের জন্য নিরাপদ হিসেবে ধারণা করেছিলো এবং এদের মাধ্যমে আজকের দিনের রোমানিয়ানদের গোড়াপত্তন হয়েছে।
অর্থাৎ চারদিকে স্লাভিক এবং ইউরালিক ভাষাগোষ্ঠীর মানুষদের দ্বারা বেষ্টিত হওয়া সত্বেও রোমানিয়াতে এ কারণে ল্যাটিন ভাষার প্রচলন ঘটে। আবার অনেকে মনে করেন যে রোমান সম্রাট নিরোর হাতে রোমের পতন ঘটলে রোম থেকে একদল মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সুউচ্চ কার্পেথিয়ান পর্বতমালা দ্বারা বেষ্টিত এ অঞ্চলটিতে তাঁরা বসতি স্থাপন করতে শুরু করে যাঁদের হাত ধরেই এ অঞ্চলটিতে ল্যাটিন ভাষার প্রচলন ঘটে।
রোমানিয়ার বাহিরে রিপাবলিক অব মলদোভাতেও একটা বড় অংশের মানুষের ভাষা রোমানিয়ান। এছাড়াও হাঙ্গেরিয়ান, সার্বিয়ান, জার্মান, ইউক্রেনিয়ান-এ সকল ভাষারও প্রচলন দেশটিতে রয়েছে। যেহেতু রোমানিয়ানরা জাতিগতভাবে ল্যাটিন এবং একই সাথে ভৌগলিকভাবে চতুর্দিক থেকে স্লাভিক ও ফিন-ইউরালিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষের দ্বারা আবদ্ধ ও দীর্ঘদিনের অটোমান শাসনের প্রভাবের কারণে অনেকে রোমানিয়াকে ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যসম্পন্ন দেশ হিসেবে আখ্যা দেন।
রোমানিয়া ইউরোপ মহাদেশের মধ্যে একটি অঞ্চল যেখানে প্রাচীন কাল থেকেই মানুষের বসবাসের প্রমাণ রয়েছে। পেশতারা কু ওয়াসে নামক একটি জায়গা রয়েছে রোমানিয়াতে যেখানে ইউরোপ মহাদেশের মধ্যে মানব সভ্যতার সবচেয়ে পুরাতন হিউম্যান ফসিলের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে এবং কার্বন ডেটিং এর মাধ্যমে এ হিউম্যান ফসিলের বয়স ৩৭,৮০০ থেকে ৪২,০০০ বলে জানা গিয়েছে।
রোমানিয়ার আজকের মানচিত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৮ সালে ফ্রান্সের ভার্সাই শহরে স্বাক্ষরিত “Treaty of Trianon” এর মধ্য দিয়ে। রোমানিয়া -এর খাবারে তুরস্ক , গ্রিস, বুলগেরিয়া, সার্বিয়া , ইউক্রেন, ইতালিতে সকল দেশের প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। ‘চরবা দে বুরতা’ রোমানিয়ার একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। ওয়াইন জন্য রোমানিয়া আলাদা এক ব্র্যান্ড সারা বিশ্বব্যাপী।
রোমানিয়ার সরকার ব্যবস্থা ইউনিটারি সেমি-প্রেসিডেন্সিয়াল রিপাবলিক যেখানে প্রধানমন্ত্রী সরকার ব্যবস্থার প্রধান ব্যক্তিত্ব। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রোমানিয়া সোভিয়েত মিলিটারি কর্তৃক আক্রমণের শিকার হয় এবং দেশটি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি স্যাটেলাইট রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত দেশটিতে কমিউনিজম ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিলও। ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত ব্যক্তিত্ব নিকোলেই চশেস্কু রোমানিয়ার এক সময়কার রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন।
ফুটবল রোমানিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় স্পোর্টস। ইউরোপের জনপ্রিয় ফুটবল ক্লাব স্টুয়া বুখারেস্টির পীঠস্থান রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে। এছাড়াও টেনিস দেশটির অন্যতম আরও একটি জনপ্রিয় স্পোর্টস। WTA-এর র্যাঙ্কিং অনুযায়ী বর্তমানে শীর্ষে থাকা টেনিস তারকা সিমোনা হালেপ একজন রোমানিয়ান। ১৯৭৬ সালে কানাডার মন্ট্রিয়ালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অলিম্পিক আসরে অলিম্পিক গেমসের ইতিহাসে সর্বপ্রথম একদম পরিপূর্ণভাবে দশে দশ দেওয়া হয় রোমানিয়ার এক জিমন্যাস্ট খেলোয়াড় নাদিয়া এলেনা কোমানেসিকে।
তিনি পাঁচটি অলিম্পিক স্বর্ণপদক অংশগ্রহণ করে লাভ করার গৌরব অর্জন করেছিলেন। পৃথিবীর অন্যতম সেরা ড্রাইভিং রোড হিসেবে পরিচিত ট্রান্সফাগারাসান হাইওয়েটি রোমানিয়াতে অবস্থিত এবং এটি পৃথিবীর সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়া ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত গতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ রোমানিয়াতে পাওয়া যায়। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ইউরোপ মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ ছিলো রোমানিয়া।
রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে অবস্থিত কিছু মনোরম কারুকার্যবিশিষ্ট বইয়ের দোকান রয়েছে। কারটুরেসি কারুসেল বইয়ের দোকানটিতে মনে করা হয় প্রায় দশ হাজারের মতো বই, পাঁচ হাজারের মতো অ্যালবাম এবং ডিভিডির মতো আরও কিছু জিনিস রয়েছে। ডাসিয়ার শেষ রাজা ডেসেবালুসের মুখচ্ছবির অনুকরণে করা শিলা ভাস্কর্যটি রোমানিয়াতে অবস্থিত।
এ শিলা ভাস্কর্যটি উচ্চতায় প্রায় ১৪০ ফুটের কাছাকাছি যা ইউরোপের উচ্চতম শিলা ভাস্কর্য। পৃথিবীর দীর্ঘতম লবণের খনি যাদুঘরটি রোমানিয়ার ক্লুজ কাউন্টিতে অবস্থিত। অদ্ভুতভাবে এ খনিটি বিভিন্ন ধরণের মেশিন এবং হাত দিয়ে খোদাই করা হয়েছে। রোমানিয়ার সিনাইয়া নামক শহরে অবস্থিত পেলেস ক্যাসেল ইউরোপ মহাদেশের মধ্যে প্রথম ইলেকট্রিভাইড ক্যাসেল।
এ ক্যাসেলের আলোকসজ্জা থেকে আরম্ভ করে বৈদ্যুতিক সকল কার্যকলাপের জন্য প্রয়োজনীয় তড়িৎ শক্তি এ ক্যাসেলের অভ্যন্তরেই উৎপাদন করা হতো এবং এখনও সে ব্যবস্থা চালু রয়েছে। নিউ ইয়র্কের পর রোমানিয়ার টিমিশোয়ারা এ পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনও শহর যেখানে বৈদ্যুতিক স্ট্রিট লাইটের ব্যবহার শুরু হয়।
‘মেরি সেমেটারি’ নামক একধরনের কবর স্থান এ রোমানিয়াতে দেখতে পাওয়া যায় যা নান্দনিক শিল্পকর্মের জন্য খুবই আকর্ষণীয়। সাপানাটা নামক গ্রামটিতে অবস্থিত এ কবরস্থানটি বর্তমানে একটি ওপেন এয়ার মিউজিয়াম এবং জাতীয় পর্যটন কেন্দ্র। ব্রাশোভে অবস্থিত স্ট্রাদা সফোরি নামক সড়কটিকে এ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সরু স্ট্রীট বলে গণ্য করা হয়। এছাড়াও সাগরপ্রেমী মানুষদের কাছে এফোরিয়ে এবং কন্সটান্টা দুইটি আদর্শ জায়গা বিশেষ করে গ্রীষ্মকালীন সময়ে।
১৯১৭ সালে দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক হওয়া ১০ বানি নোটটিকে এ যাবৎ কাল পর্যন্ত এ পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র কাগজের মুদ্রা হিসেবে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও অনেকে মনে করেন যে আজকের দিনে অন্যতম জনপ্রিয় খাবার স্টেকের উতপত্তি হয়েছে আসলে রোমানিয়াতে যদিও এ ব্যাপারে এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় নি।
রোমানিয়াতে কালো জাদুর বা ব্ল্যাক ম্যাজিকের ওপর ট্যাক্স বসানও আছে। রোমানিয়াতে সরকারিভাবে এ কালো জাদুর বা ব্ল্যাক ম্যাজিককে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং যে সকল মানুষ জাদু বিদ্যা কিংবা মানুষের ভবিষ্যৎ গণনার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে তাদের ওপরে এ ট্যাক্স বসানো রয়েছে। এ পেশায় নিয়োজিত হতে হলে সরকার থেকে লাইসেন্স পারমিটের প্রয়োজন হয়।
রোমানিয়া -এর সাথে বিশ্ববিখ্যাত অনেক আবিষ্কার এবং বৈজ্ঞানিকের নাম জড়িত। জেট ইঞ্জিনের এর সর্বপ্রথম আবিষ্কার এ রোমানিয়াতে হয়েছিলও এবং জেট ইঞ্জিনের এর যিনি আবিষ্কারক ছিলেন তাঁর নাম হেনরি মারি কোয়ান্ডা। তিনি হলেন একজন রোমানিয়ান। এছাড়াও মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বপ্রথম কৃত্রিমভাবে ইনসুলিন প্রস্তুত করা নিকোলে কন্সটানটিন পাওলেস্কু ছিলেন একজন রোমানিয়ান চিকিৎসক। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ফাউন্টেন পেন প্রস্তুত করেন পেট্রাচে পোয়েনারু যিনি ছিলেন একজন রোমানিয়ান।
জর্জ এমিল পালাদে, স্টেফান ওয়াল্টার হেল্ট, হেরটা মুয়েলার কিংবা এলিজার ইউসেল-এর মতো নোবেল পুরষ্কার জয়ী বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের জন্ম হয়েছিলও রোমানিয়াতে। স্ট্যান লী এ নামটির সাথে পরিচয় নেই এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। হাল্ক, স্পাইডারম্যান, এক্স-মেন, থোর, ক্যাপ্টেন আমেরিকা, আইরন ম্যান, অ্যান্টম্যান, ডেডপুল, ফ্যান্টাসটিক ফোর, ইলেক্ট্রা এ সকল জনপ্রিয় কমিক ক্যারেক্টার সিরিজ অর্থাৎ মারভেল কমিক সিরিজের স্রষ্টা স্ট্যান লীও ছিলেন একজন রোমানিয়ান বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক।
এছাড়াও আইরিশ ঔপন্যাসিক ব্রাম স্টোকার রচিত বিখ্যাত চরিত্র ড্রাকুলা বা ভ্যাম্পায়ারের চরিত্রটি চিত্রায়িত হয়েছে ওয়ালাসিয়ার বিখ্যাত অর্থোডোক্স রাজা ভ্লাদ দ্যা ইম্পাল্যারকে অনুসরণ করে যিনি রোমানিয়ার সিঘিসোয়ারাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে এ ড্রাকুলা সিরিজের ওপর অনেক সিনেমা নির্মিত হয়েছে। ব্রাশোভ থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ব্রান নামক একটি স্থানে তিনি একটি ক্যাসেল নির্মাণ করেছিলেন যা ‘ড্রাকুলা ক্যাসেল’ নামে পরিচিত।
লেখক- রাকিব হাসান রাফি, স্লোভেনিয়া