করোনার করাল গ্রাসে নাস্তানাবুদ বিশ্ব। চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় দুইশ দেশের মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত মানুষ ও মৃতের সংখ্য। চীনের চেয়ে উন্নত-অনুন্নত, দূরে কিংবা নিকট প্রতিবেশী; কোনো রাষ্ট্রই এই দুর্যোগ থেকে রেহাই পায়নি।
প্রতিদিন সংবাদে উঠে আসছে সেসব খবর। তবে করোনার কালো স্রোতের বিপরীতমুখী রূপ যেন উত্তর কোরিয়াতে। দেশটির সরকারের দাবি সেখানে কোনো করোনা রোগী নেই। অথচ উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চীনের রয়েছে ১ হাজার ৪ শ’ ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমানা। হাতে গোনা যে ক’টি রাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার গভীর অভ্যান্তরীণ যোগাযোগ রয়েছে তার মধ্যে চীনের অবস্থান শীর্ষে। দুই দেশের নীতি নির্ধারকদের মধ্যেও রয়েছে ব্যক্তিগত যোগাযোগ। এতসব সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও যে ভাইরাস হাজার কিলোমিটার দূরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছে, সেই ভাইরাস পাশের দেশ উত্তর কোরিয়ায় কোনো প্রভাবই ফেলেনি এটা অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। অথচ এই দেশটি বাদে চীনের সীমান্ত ঘেঁষা প্রতিটি রাষ্ট্র করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। তারা বাঁচার জন্য লড়াই করছে।
অথচ পিয়ং ইয়ংয়ের দাবি, তাদের দেশে করোনা সংক্রমণের কোনো খবর নেই। ভাইরাস সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে! উত্তর কোরিয়ার এই দাবি নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তথ্য গোপনের অভিযোগ উঠেছে কিম জং উনের সরকারের বিরুদ্ধে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ বিষয়ে অনেক কথা হচ্ছে। বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলোও প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। তবে উত্তর কোরিয়া তার অবস্থানে অনড়। তাদের দাবি, গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে।
আপনি জানেন, উত্তর কোরিয়ার যে কোনো সঠিক সংবাদ বা তথ্য জানতে হলে আপনাকে বিশ্ব গণমাধ্যমের ওপর নির্ভর করতে হবে। কারণ নিভৃতচারী দেশটিতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই। নেই বর্তমান সময়ের নাগরিক সাংবাদিকতার হাতিয়ার হয়ে ওঠা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। উত্তর কোরিয়ার নাগরিকদের ইন্টারনেট ব্যবহারেও রয়েছে নানা বাধ্যবাধকতা। ফলে উত্তর কোরিয়া যে করোনা পরিস্থিতির তথ্য লুকাতে পারে গবেষকদের এমন দাবি মোটেও অমূলক নয়।
গত ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখ উত্তর কোরিয়ায় প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে সন্দেহে একজন নাগরিককে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়। একদিন পর তাকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে দেশটির দৈনিক ‘ডং-এ ইলবো’ এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করে। কারণ হিসেবে দেখানো হয়, সে সরকারি আদেশ অমান্য করে গণ-শৌচাগারে গিয়েছিল। এই অপরাধে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তবে গবেষকদের সন্দেহ ওই ব্যক্তির শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়ায় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
এই ঘটনার পরপরই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় সতর্কতা হিসেবে উত্তর কোরিয়ায় বিশেষ আইন জারি করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট কিম জং উন। শরীরে করোনার উপস্থিতি না পাওয়া গেলেও চীনাদের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে অথবা সম্প্রতি চীন ভ্রমণ করেছেন; এমন যেকোনো ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। এই সকল ব্যবস্থা থেকেই বোঝা যায় উত্তর কোরিয়ান চিকিৎসকরা ওই সময়ে নাগরিকদের মধ্যে করোনাভাইরাসের উপস্থিতির প্রমাণ পেয়েছিলেন।
গবেষকদের এই দাবির সত্যতাকে আরো জোরাল করে তোলে ১০ মার্চ প্রকাশিত ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’র একটি প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়, কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে উত্তর কোরিয়ার প্রায় দুই শতাধিক সেনা মারা গেছেন। এছাড়া আরো কয়েক হাজার সেনাকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘ডেইলি এনকে’ জানায়, গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে করোনায় উত্তর কোরিয়ার ১৮০ জন সেনা মারা গেছেন। প্রায় চার হাজার সেনাকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।
এছাড়া করোনা আতঙ্কে প্রায় দশ হাজার মানুষকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে করোনা শনাক্ত না হওয়ায় প্রায় চার হাজার মানুষকে হাসপাতাল থেকে করোনা মুক্তের ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। তবে উত্তর কোরিয়ার সরকার সংবাদগুলোকে ভিত্তিহীন দাবি করেছে। সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে উত্তর কোরিয়ার সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম ‘রোডং সিনমুন’ দাবি করে, এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমণের কোনো ঘটনা উত্তর কোরিয়ায় ঘটেনি।
এছাড়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক বোঝাতে বিশ্বজোড়া করোনা ত্রাসের মধ্যেই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে উত্তর কোরিয়া। চলছে সামরিক মহড়া। এছাড়া সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এত দিন যে বিদেশিদের তারা কোয়ারেন্টাইনে রেখেছিল, তাদের সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
তবে সরকার যাই বলুক বা করুক না কেন দক্ষিণ কোরিয়ায় বসবাসরত উত্তর কোরিয়ার নাগরিকরা বলছে ভিন্ন কথা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নাগরিকরা দক্ষিণ কোরিয়ান গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুখ খুলছেন। তাদের ভাষ্যমতে, উত্তর কোরিয়ায় আত্মীয়দের কাছ থেকে তারা যে খবর পাচ্ছেন, তাতে পরিস্থিতি এখন রীতিমতো উদ্বেগজনক! সেখানে নামে মাত্র পরীক্ষা চলছে, যা মোটেও যথেষ্ট নয়। অনেক লোক পরীক্ষা ছাড়াই করোনার সংক্রমণের লক্ষণ নিয়ে মারা যাচ্ছে।
উত্তর কোরিয়ার সরকার সে দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে যাই বলুক না কেন, দেশটিতে করোনার এই বিপরীতমুখী আচরণে গবেষকরা বিস্মিত। তাদের মতে, হয় করোনা পরিস্থিতি সেখানে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, না-হয় উত্তর কোরিয়ার সরকার ভয়াবহতার প্রকৃত চিত্র লুকিয়ে রেখেছে। কারণ পূর্বে এমন অনেক মহামারির প্রকৃত চিত্র গোপন করেছে দেশটির সরকার। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৯০ সালের দুর্ভিক্ষ এবং ২০০৬ ও ২০০৭ সালের হাম মহামারিতে ঠিক কতজন মারা গিয়েছিল তা আজও জানা যায়নি। তাই বিশ্বের অনেক গবেষকই একমত হয়েছেন যে উত্তর কোরিয়ার সরকার সে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে মিথ্যাচার করছে।