Search
Close this search box.
Search
Close this search box.
bangladeshi-labour
ফাইল ছবি

ছুটির দিন অবসর সময়টাকে ইতিবাচক কিছু কাজে ব্যস্ত রাখার প্রয়াসে নতুন নতুন পুস্তক আর হলিউডের ডিটেকটিভ মুভি দেখেই দিন শেষ হয়। নিজেকে সাজানোর যত পরিকল্পনা সেই ছুটির দিনেই। খুব করে চাই নিজেকে সময় দিতে আত্ন উন্নয়নে আরো মনোযোগী হতে। আজ রুটিন করে বসেছি কোন কিছু নড়চড় যেন না হয়, ফেসবুকিং একেবারে সীমিত করার প্ল্যান সাথে উপযুক্ত ব্যবহার। আজ বহুদিন পর ডা লুতফর রহমান এর শ্রেষ্ঠ রচনা সমগ্র বইটি বের করলাম পড়ার জন্য, পড়তেছিলাম বইয়ের মহৎ জীবন অংশবিশেষ, কতবার যে পড়ছি এই কলাম হিসেবে নেই।

প্রেরণা পাই যে বেঁচে থাকার সাথে বেঁচে থাকার মন্ত্র, ভালো লাগাটা এজন্যই! পড়তেছিলাম উক্ত বইয়ে দার্শনিক ব্রাউন এর জীবনী, এমনি সময় মেসেঞ্জার এ কল আসায় মুঠোফোনে ভোঁভোঁ শব্দ শুরু। পরিচিত নিকটাত্মীয় সালাম ভাই সুদূর সৌদি আরব থেকে। বহুবছর পর ভাই এর ফোন।কথা, যোগাযোগ নেই কত বছর !হটাৎ কি মনে করে ফোন একটু কটকায় লেগে গেলো আমার! কারন সারা ফোন তো দিবেনা এমনটাই কেন জানি!

chardike-ad

ফোন রিসিভ করে কথপোকথন, কেমন আছেন, শরীর কেমন, কতদিন যোগাযোগ নেই……. সালাম ভাই, আমার বকবকানি তে প্রতি উত্তরের সুযোগ পায়নি সে । সেই কবে তোমার সাথে কথা
আমিন! সৌদি ফ্লাইট এর আগের রাতে ঢাকায় তোমার বাসায় থাকলাম,সেই শেষ দেখা, শেষ কথা! দেখতে দেখতে কয়েক বছর কেটে গেলো। জানোই তো পড়াশুনা জানিনা অন্য একজনকে দিয়ে তোমার ফেসবুক আইডি সার্চ দিয়ে তার পরে তো ফোন দিলাম তোমাকে। আসলেই সময়ের সাথে যদি দূরত্বের বাড়তে থাকে সম্পর্কের মাঝে একটু আধটু ফাটল হয়ই। খুব মিস করা হয় ওদেখাতে ,আর যদি যোগাযোগের মাধ্যম একেবারেই না থাকে কষ্ট একটু বেশিই লাগে প্রিয় মানুষদের জন্য।

সালাম ভাই আপনাকে এত গম্ভীর মনে হচ্ছে কেন ? কোন বিপদে পরছেন নাকি ভাই কেন জানি বলেই ফেললাম আমার সন্দেহের কথা !না তবে অনেক বড় ঘটনা ঘটেছে রে-অনেক কথার ফাঁকে সালাম ভাই বললো তুমি কিছু শুনছ ? আমি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম কি শুনবো ভাই ! এমন কথা শুনে মনে মনে একটু ভয় পেয়ে গেলাম ! মনে হয় কেউ মারা গেছে আর সেটা আমাকে কেউ বলে নি এরকম কিছু!

প্রবাসে এমন ভাবনাটা নৈমত্তিক বিষয় বেশি কষ্ট পাবে কান্নাকাটি করবে এই ভয়ে অনেকে আত্নীয় স্বজনের মৃত্যুর খবর পর্যন্ত গোপন রাখে। ভাবলাম এরকম কিছু ঘটেছে কিনা? সালাম ভাই ওপাশ থেকে মনে হয় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে শুনলাম তোমার বোন তো আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, তালাক দিয়েছে অন্য জনকে বিয়ে করেছে।

এমন কথা শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি ! বিশ্বাস হচ্ছিলনা ভাইয়ের কথা আমার। কিন্তু ভুক্তভুগি সেই যখন বলছে বিশ্বাস না করার উপায় কি আছে ? সত্য জেনেও আমি আরো একবার বললাম ভাই সত্যি কি ঘটনা এইটাই ? সালাম ভাই এবার হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। বুঝলাম সে চলে গেছে আমার বড় মেয়েটা আর ছোট ছেলেটার কি হবে ? দেখবে কে ওদের এখন, মা থেকেও নাই ওদের,কেমনে করল এ কাজ সে ,ছেলে মেয়ে দুইটা কি শিখবে ওর কাছ থেকে? সমাজের মানুষ আমার সন্তানদের কি বলবে কেমন মা ,তোদের ছেড়ে চলে গেল কি উত্তর দিবে তারা ।আর আমি বাবা হয়ে ছেলে মেয়ে দুইটার ভবিষ্যৎ চিন্তা করলে ঠিক থাকতে পারিনা ভাই ! কি বলবো তোমাকে ?এত বছরের সংসার এভাবে শেষ করে দিয়ে দিলো, সালাম ভাইয়ের আজহারিতে এই পাশে আমি নিস্তব্ধ ,সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছি , কারও পারিবারিক কষ্টের কথা শুনবো,আর এরকমভাবে কেউ আপন করে নিজের কষ্টের কথা আমাকে বলবে , আমার জীবনে এটাই প্রথম ছিল ।

আসলে এ ব্যথা যার সে সারা কেউ বুজবার নয়। অন্তর পুড়ে যায় হৃদয় ক্ষত হয় কেউ বুঝেনা কষ্ট, তাও আবার প্রবাসে এমন পরিনাম ।আমার নাকি টাকা নেই ,সংসার চালাতে পারিনা এজন্যই তালাক দিয়ে বিয়ে করেছে মিথ্যাবাদী ভণ্ড একবারও চিন্তা করলনা ছেলেমেয়েগুলার কথা। আরে ভণ্ড মেয়ে সংসার যদি চালাতে নাই পারি ১৫ টা বছর ক্যামনে চলল সে উত্তর আমাকে দিক? আর মাসে মাসে আমার সমুদয় ইনকামের টাকা পাঠাইছি তাকে সে টাকা আমাকে ফেরত দিক ,লম্পট মেয়ে এমনি ভাবে নিজের আক্ষেপ আমাকে বলল ,বুঝলাম প্রবাসে থেকে নিজের কষ্টের কথাও না পারে কাউকে বলতে ,না পারে নিজের সাথে হিসেব মিলাতে।

যাকে বিয়ে করেছে সেও নাকি বিদেশ থাকে অনেক টাকা তার। রাজরানী হয়ে থাকবে এই স্বপ্নে। আমার জীবনটাই শেষ করে দিলো ,আমি বাঁচার কোনো পথ দেখিনা ভাই। সালাম ভাইয়ের আক্ষেপ আর কষ্টের এসব কথা শুনে আমি কি বলব তাকে,কি বলে সান্ত্বনা দিব, চুপ করে হৃদয় ভাঙ্গার কথা গুলো।

শুনেছি মাত্র মানুষ এত নিচু হতে পারে, স্বামী সংসার তুচ্ছ করে নতুন সংসার পাতে নতুন সুখের খোঁজে ,এই মহিলাকে কি বলবো ঘৃণা আর অভিসম্পাত আসেছিল বারবার ।ছেলে মেয়ে গুলার মুখ তাকিয়েও তো এমন সিধান্ত ত্যাগ করা উচিত ছিল ।

সালাম ভাই বললো তোমাকে যে জন্য ফোন দিছি ভাই ,তুমি ফোন করে তাকে মানে তার সাবেক বউকে তুমি ফোন করে একবার বলিও যে সে যা ভুল করেছে ,ছেলে মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি তবুও মেনে নিয়েছি তার সব অপকর্ম যাই হোক সে জেনো ফিরে আসে আমার সংসারে , আমি মেনে নিব তাকে । তাকে এতটুকু বুঝাও তুমি। সালাম ভাইয়ের আরজি আর আকুতির ওজনটা বুঝতে আমার কষ্ট হয়নি, কুল বিবাগী দানা ঝাঁপটায় আপন নীড়ের খোঁজে ,কততুকু ভালোবাসা আর মায়া থাকলে স্থান দিতে চায় আবারও তাকে ,আসলে এমন ভালোবাসা বাঙ্গালি পরিবার সমাজে এখন আছে বলেই আমাদের সমাজ ,পরিবারগুলো অনেক সুন্দর ,ভালবাসার উষ্ণ চাদরে জড়ানো ।

ফোনের ওপর প্রান্তে থেকে তার হৃদয় কম্পন অনুভূতিও অন্তর থেকে চাওয়ার বাসনা সবটুকুই আঁচ করতে পেরেছিলাম । আমি তাদের সম্পর্ক যেন পুনরায় জোড়া লাগে এজন্য সব চেষ্টা করব এই বলে আশ্বস্ত করেছিলাম সালাম ভাইকে।

সে তার সাবেক বউ এর ইচ্ছা আর সে কি আবার তার ঘর করবে সে খবর অচিরেই শুনতে চায়। কথা শেষ এর দিকে ভাইকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম ,মানসিক ভাবে ভাল থাকবেন ভাই ,এই প্রবাসে আপনার কষ্ট আমিও বুঝি ভাই ।এর পরেও ভাগ্যকে মেনে নিতেই হবে ,জীবন থেমে যেন না যায় !এ বলেই কথা শেষ করছিলাম

কল কেটে দেয়ার পর আর বই পড়তে পারলাম না, খেয়ালে গেলাম এই তো কয়েক বছর আগে দেশে একটা সময় রেস্টুরেন্ট ছিল সালাম ভাইয়ের , কত সুন্দর দিনপদ ছিল ,মাঝে কখনো ঘুরে বেড়ানোর ছলে সালাম ভাইয়ের রেস্টুরেন্ট এ গেলে পেট পুড়ে খাওয়াইতো ,কোনো বিল নিতো না ,সময়ের ব্যবধানে রেস্টুরেন্ট টা আর চালাতে পারলনা ,ঋন ধারদেনা বাড়তেই থাকে ,শৌখিন মানুষ অন্য কোনো কাজ ও ঠিক মতো করতে পারেনা ,সংসার ত চালাতেই হবে ,ধার দেনা করে শেষমেশ সৌদির ভিসা পেয়েছিলো ,দালালদের দৌরাত্বে আর এজেন্সির বাটপার অভিনব ভিসা অফিসার এর নামে গুনতে হয়েছিল ৬/৭ লক্ষ টাকা।

২/৩ বছর হচ্ছে সৌদিতেই আছে সালাম ভাই ঋণ অনেকটা পরিশোধ এর কাছাকাছি। আর কয়েক বছর থেকে আরো কিছু টাকা ইনকাম করে একেবারে দেশে চলে যাবে। ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা করাবে কত স্বপ্ন তার ছিল।মাঝপথে এসে এমন আচমকা ধাক্কা কে পারে সামাল দিতে এমনটা ?খুব কঠিন তার জন্য ১৪ বছরের বড় মেয়েটা আর কোলে ছেলে সন্তান এসবের মায়া একটুকুও না করে অন্য ছেলের সাথে চলে যাওয়া এমন বিদারক সহজে কি মেনে নেয়া যায় !ভাবি আর চিন্তা করি আমি ,এতগুলো বছর এক ছাদে থেকেও ভালোবাসাটা স্থির থাকেনা ,এত টুকুও মায়াও আসে না ,বন্ধন এত নাজুক। গহীনের লেনাদেনা ,এতটাই ঠুনকা ।সুখ নামক মরীচিকার পিছনে ছুটতে গিয়ে নতুনত্ব পেতে হাজারো বন্ধন ,পারিবারিক মায়া ,স্বামী স্ত্রীর বহুদিনের বন্ধন সবকিছুই মূল্যহীন হয় নতুন কোনো স্বপ্নে, নতুন কোনো অতিথির হাত ধরে নিঃশেষ হয় পরিবারগুলি সম্পর্কগুলি। তবে প্রশ্ন থেকে যায় আসলে তারা কি আসলে সুখ খুঁজে পায় ?

প্রশ্নটা একা আমার না ভুক্তভুগি দেরও ।সালাম ভাইয়ের মত বহু পরিবার ভেঙে যাচ্ছে প্রতিদিন ,প্রবাস জীবনে এমনি ভাবে কাজ শেষ এ ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফিরে এমন সংবাদ অনেকেই শুনার জন্য আদৌ কেউ কি প্রস্তুত থাকে? তবুও মেনে নিতে হয় এমন সংবাদ ,বিদেশে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করে যাদের জন্য সমুদয় ত্যাগ স্বীকার সেই মানুষ অনেকটা নতুন স্বপ্নে সব জলাঞ্জলি দেয়।

বাংলাদেশে এমনিভাবে তালাক এর হার দিন দিন বেড়েই চলছে, এতে শুধু স্বামী স্ত্রী দু জনেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না শিশু ,ছেলে মেয়েদের উপর ব্যপক প্রভাব পরছে ।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলতেছে তালাকে পুরুষের চেয়ে নারীরা এগিয়ে।এই সমীকরণ এ প্রবাসীদের পরিবার গুলোতে নারীদের তালাকের হার ক্রমশ বেড়েই চলেছে

একটু সচেতন হই ,একটা সম্পর্ক ভাঙার আগে আর একটিবার ভেবে দেখি। একটি পরিবার ভাঙার সাথে অনেক জীবন জড়িত একটু উপলব্ধি তে আসা দরকার সবার। সালাম ভাইয়ের স্বপ্ন পরিবার আর কিছুই নেই অবধি।
আমি শেষত সালাম ভাইয়ের সেই অনুরোধটা রাখতে পারিনি ,খোঁজ নিয়ে জানলাম ওই মেয়েকে অনেকেই অনুরোধ করেছে যা হয়েছে হোক ,যেন ফিরে আসে সালাম ভাইয়ের কাছে ,কারো কথার দাম দেয়নি ,সাফ জানিয়ে দিয়েছে আমার যা ভালো হয়েছে তাই করেছি।সালামের সাথে আর সংসার নয়।

এজন্য আমি আর নতুন করে ওই মেয়েকে অনুরোধ করিনি ফলে সালাম ভাইয়ের জন্য কিছু করতে পারিনি। এমন মেয়েকে কি বলবো কি বা বলার ছিল নতুন করে আমার! অনেক দিন পর সালাম ভাইকে ফোন দিছিলাম বললাম সব বিত্তান্ত। দেখলাম আগের চেয়ে উনি অনেক মানসিক ভাবে শক্তিশালী ,বললো আমার মেয়েটার বিয়ের জন্য কিছু টাকা জমাচ্ছি,দেশে ফেরত যাওয়ার ইচ্ছা নেই ভাই, কার জন্য যাবো। আগের চেয়ে দৃঢ় চেতাই মনে হলো সালাম ভাইকে। প্রবাসে মানসিক ভাবে যেন মজবুত থাকে এমনটাই মনে মনে তার জন্য প্রার্থনা করলাম।

সালাম ভাইয়ের মতো প্রবাসী হোক আর দেশেই অবস্থান করুক এমন ভাগ্যবরণ যেন সবার না হয়, ভালোবাসার পবিত্র বন্ধন যেন অটুট থাকে পরিবার গুলোতে যেন হয়ে ওঠে এক একট স্বর্গ উদ্যান। পারস্পরিক বিশ্বাস, ত্যাগ উভয়ের থাকা চাই।

হোসাইন নুর-আলম, জাপান প্রবাসী