চীন থেকে শুরু, এরপর একে একে বিশ্বের অন্তত ১৪৫টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে নভেল করোনাভাইরাস। চীনে তিন হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়েছে কোভিড-১৯। এখন তাণ্ডব চালাচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যে। সেদিক থেকে সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র দক্ষিণ কোরিয়ায়। গত মাসে হঠাৎ করেই ব্যাপক হারে করোনার সংক্রমণ শুরু হয় দেশটিতে। দিনে ছয়-সাতশ’ মানুষও আক্রান্ত হয়েছে সেখানে। কিন্তু কয়েক দিনের ব্যবধানেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে তারা।
কীভাবে? চলুন, জেনে নেয়া যাক-
১) সেলফ কোয়ারেন্টাইন: করোনার উৎস চীনে গোটা হুবেই প্রদেশ অবরুদ্ধ প্রায় তিন মাস ধরে। ইতালির ১৪টি প্রদেশ, ইরানের অধিকাংশ এলাকাই অবরুদ্ধ ঘোষণা করেছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব- সবাই একই পথে হাঁটছে। ব্যতিক্রম শুধু দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটির কোথাও অবরুদ্ধ পরিস্থিতি নেই, এমনকি সেখানে করোনা সংক্রমণের কেন্দ্র ডেগু শহরেও নয়।
এর বদলে কোরীয় কর্তৃপক্ষ ভাইরাস আক্রান্ত বা সন্দেহজনক ব্যক্তিদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে থাকার নিয়ম করেছে। এছাড়া, জনগণকে যথাসম্ভব ভিড় এড়িয়ে চলা, অনুষ্ঠান পরিহার, মাস্ক পরিধান এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
২) বিমানবন্দরে বিশেষ ব্যবস্থা: যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশ করোনায় ভুক্তভোগী ইউরোপ, চীন, ইরানের ওপর সরাসরি ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কিন্তু, সে পথেও হাঁটেনি সিউল। বরং তারা ওইসব দেশগুলো থেকে আগত যাত্রীদের জন্য বিমানবন্দরে বিশেষ ব্যবস্থা চালু করেছে। সেখানে যাত্রীদের শারীরিক তাপমাত্রা পরীক্ষা, খুঁটিনাটি ভ্রমণ তথ্য, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিস্তারিত প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে।
৩) মেডিকেল টেস্টে রেকর্ড: যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল সরকার, রাজ্য সরকার, সরকারি-বেসরকারি ল্যাবরেটরিগুলোতে বিক্ষিপ্তভাবে করোনাভাইরাস টেস্ট করা হচ্ছে। ফলে এ পর্যন্ত মোট কতজনের শারীরিক পরীক্ষা করা হয়েছে তা বলতে পারছে না ওয়াশিংটন। দ্য আটিলান্টিক ম্যাগাজিনের হিসাবে, এ সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি হবে না।
সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনায় করোনা টেস্টে দারুণ সফল দক্ষিণ কোরিয়া। বিশ্বের যে কোনও দেশের তুলনায় তাদের গড় পরীক্ষার হার সবচেয়ে বেশি। গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত অন্তত আড়াই লাখ মানুষের শারীরিক পরীক্ষা করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। দেশটিতে প্রতিদিন অন্তত ১৫ হাজার মানুষের করোনা টেস্ট করা হচ্ছে।
৪) বিনামূল্যে মেডিকেল টেস্ট: সন্দেহভাজন করোনা রোগীদের মেডিকেল টেস্ট সম্পূর্ণ ফ্রি করে দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। চিকিৎসকরা রেফার্ড করলে সন্দেহভাজন রোগীরা বিনামূল্যেই টেস্ট করাতে পারছেন। বাকিদের জন্যেও সাশ্রয়ী মূল্যে মেডিকেল টেস্টের ব্যবস্থা করেছে সেখানকার সরকার। দেশটির শতাধিক হাসপাতাল-ক্লিনিকের পাশাপাশি করোনাভাইরাস টেস্টে প্রায় অর্ধশত ভ্রাম্যমাণ ল্যাবরেটরিও কাজ করছে।
৫) তথ্যের ব্যবহার: নাগরিকদের সংগৃহীত তথ্য ব্যবহার করে সহজেই ভাইরাস সংক্রমণের উৎস নির্ধারণ, আক্রান্ত বা সন্দেহভাজনদের চিকিৎসা ও কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা করছে দক্ষিণ কোরিয়ার কর্তৃপক্ষ। কোন এলাকায় ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি, এমনকি কোন দোকান বা রেস্টুরেন্টে গিয়ে কেউ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন তাও এসএমএসের মাধ্যমে স্থানীয়দের জানিয়ে দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
এসব তথ্য ব্যবহার করেই করোনা সংক্রমণের হার আশ্চর্যজনকভাবে কমিয়ে এনেছে দক্ষিণ কোরিয়া। সেখানে মৃত্যুহারও অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক কম। ইতালিতে করোনা আক্রান্তদের মৃত্যুহার যেখানে পাঁচ শতাংশ, সেখানে দক্ষিণ কোরিয়ায় মৃত্যুহার ০.৮ শতাংশ মাত্র।
৬) অতীত থেকে শিক্ষা: কোরিয়া ইউনিভার্সিটির মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক কিম উ-জু বলেন, ২০০৯ সালে নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জা ও ২০১৫ সালে মার্স প্রাদুর্ভাবের পর দক্ষিণ কোরিয়ার টেস্ট করার সক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বিষয়ে তারা এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা দেশ।
৭) স্বচ্ছতা: অন্যান্য দেশ যেখানে ভাইরাস সংক্রমণের উৎস বা বাহকের পরিচয় প্রকাশে দ্বিধান্বিত, সেখানে অবলীলায় এ তথ্য প্রকাশ করছে দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটিতে ভাইরাস ছড়িয়েছে মূলত শিনচিয়নজি নামে একটি গির্জা থেকে। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি সত্ত্বেও নিদের্শনা অমান্য করে অনুষ্ঠান আয়োজন করায় তাদের কড়া সমালোচনা করেছে সিউল প্রশাসন। করোনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে ধর্মীয় সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও পিছপা হয়নি তারা।
৮) অন্যান্য: দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনা সংক্রমণের কারণে সব স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে রেকর্ড গড়েছে স্বেচ্ছায় আইসোলেশনে যাওয়ার হার। গত ১৫ দিনে দেশটিতে সাময়িক বন্ধ অন্তত ১২ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন দিতে সরকারের কাছে ভতুর্কির জন্য আবেদন করেছে। ডেগু শহরের তিন-চতুর্থাংশ দোকানপাটই বন্ধ। মানুষজন ঘর থেকে বের না হওয়ায় শপিংমল-সিনেমা হলগুলো খাঁ খাঁ করছে। ক্যাথলিক গির্জা ও বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে জমায়েত ও প্রার্থনা বাতিল করা হয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশটিতে করোনা নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে সেখানকার বাসিন্দাদের সচেতনতা ও শৃঙ্খলা। মূলত জনগণের সাহায্যেই দেশটিতে করোনা মহামারি প্রতিরোধে সক্ষম হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া।
সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট