একদিন গেলাম বোখারার ঐতিহাসিক মীর আরব মাদরাসায়। এটি এক হিসাবে এশিয়ার প্রথম মাদরাসা। বর্তমান যে ভবনটি রয়েছে এর বয়সই পাঁচশ’ বছরের বেশি। আর মাদারাসাটির বয়স কমপক্ষে আটশ’ বছর। বাদশাহ তৈমুর লং এটির প্রতিষ্ঠাতা। এর একটি মিনার আছে, যা পুরা বোখার শহর থেকে দেখা যায়। কাকালদাশ টাওয়ার বোখারার স্কাইলাইনের বিশ্ব ব্রান্ড। বিশেষ করে রাতের বেলা এর আলোকসজ্জা বোখারার দিগন্তে আলোর মিনার হয়ে দৃশ্যমান হয়। মীর আরব মাদরাসা ও মসজিদ যে কত বড় সেটি পাঠক ধারণা করারও ক্ষমতা রাখেন না।
আমরা অনেক দূরে গাড়ি রেখে বোখারার ঐতিহাসিক চৌরি বাজার পায়ে হেঁটে পার হয়ে মাদরাসার মসজিদে গিয়ে মাগরিব পড়লাম। মসজিদের গেইট ও প্রাচীর কমপক্ষে ছয় তলা উঁচু। এর আগে যে শান বাধানো বহিরচত্বরটি আমরা পার হলাম এটি ঢাকা স্টেডিয়ামের অর্ধেক হবে। গেইটের দু’পাশে পিতলের ফলকে মসজিদটির নাম, পরিচয়, প্রতিষ্ঠাকাল লেখা। ফটক পার হয়ে ভেতরের প্রাঙ্গণ। দুই তিনশ’ হাত চওড়া। লম্বায় হাজার বারোশ’ হাত হবে।
চার পাশেই বিশাল ভবন। স্তম্ভের সারি। এক সারি স্তম্ভের পর আরেক সারি। এভাবে চার সারি। মাপ-জোক করার সময়, সুযোগ বা সুবিধা ছিল না। তবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যসমূহের মধ্যে এটিও অন্যতম। কেউ ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে মীর আরব মাদরাসা ও গ্র্যান্ড মসজিদের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, নির্মাণশৈলী, বৈশিষ্ট্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য সবকিছুই জেনে নিতে পারেন। তবে আমার ধারণায় মসজিদের ভেতর প্রাঙ্গণ ও চারপাশের মাদরাসায় কমপক্ষে দেড় দুই লাখ লোক জমা হতে পারবে।
অতীতে এখানে বসেই ইমাম বুখারীর ছাত্ররা বুখারীর পান্ডুলিপি তৈরি করেছেন। এখানেই মসজিদে তালিম ও চারপাশের খোলা বারান্দায় ইসলামী ও সে সময়কার আধুনিক সকল জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়া হয়েছে। দুনিয়ার সব জায়গা থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে ছুটে এসেছেন। মাঝের প্রাঙ্গণে সামরিক প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে। মসজিদের সামনেই একটি জায়গা চিহ্নিত আছে। যেখানে শাসক কিংবা বড় আলেমগণ বসে জাতিকে নির্দেশনা দিতেন। একটি গাছ চারপাশে ডালপালা বিস্তার করে এখনও বড় মসজিদের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে। যার চার পাশে উঁচু গোলাকার বাঁধাই করা বসার জায়গা। গাছটি কত দিনের পুরনো তা উপস্থিত কেউ বলতে পারেনি।
মসজিদে মাগরিব যে ইমাম পড়ালেন, নামাযের পর তিনি আমাদের সাথে দেখা করে বললেন, তিনি এখানকার ছাত্র। বললাম, কোনো উস্তাদ আছেন কি না? একটু পর উস্তাদদের দুয়েক জন ছুটে এলেন। একদল ছাত্র আমাদের মূল মাদরাসায় নিয়ে গেল। মাদরাসাটি মসজিদের ঠিক উল্টো পাশে। এসব প্রাচীন স্থাপত্য কী পরিমাণ মজবুত ও বিশাল, তা নিজের চোখে না দেখলে কেউ ভাবতেও পারবে না। মাদরাসার ভিটির উচ্চতাই হবে কমপেক্ষ ১০-১৫ হাত। সিঁড়ি বেয়ে আমরা মাদরাসার গেইটের নিচে দাঁড়ালাম। যার উচ্চতা আগেই বলেছি, ৫-৬ তলার কম নয়।
চারপাশের দেয়ালও ঠিক এমনই। প্রাচীন আমলের মাদরাসা বর্তমান যুগের যেকোনো দুর্গের চেয়েও মজবুত। কমিউনিজমের যুগ শেষ হওয়ার পর স্বাধীন সরকার মাদরাসার গেইটে পিতলের ফলক স্থাপন করেছে। এতে মাদরাসার নাম, প্রতিষ্ঠাকাল ইত্যাদি লেখা। প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশের সময় আমার খুব মনে পড়ছিল আব্বার কথা।
কারণ, সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম বিশ্বের কী কী ক্ষতি হয়েছিল এ সম্পর্কে কমপক্ষে ৩৫ বছর আগে আব্বার একটি বক্তৃতার সময় জীবনে প্রথম আমি মীর আরব মাদরাসার নামটি শুনেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, বুখারার মীরে আরব মাদরাসাকে নাস্তিকরা ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করেছে। যদি আমাদের দেশেও নাস্তিক্যবাদ রোখা না যায় তা হলে খোদা না করুন, এ দেশের মসজিদ-মাদরাসারও একই দশা হতে পারে। কথাগুলো কানে বাজছিল। আব্বার স্মৃতি জাগ্রত হওয়ায় আমি কিছুক্ষণ বেশ আনমনা হয়ে পড়ি। আব্বার জন্য অনেক দোয়া করতে থাকি।
লেখক- উবায়দুর রহমান খান নদভী