হঠাৎ বিত্তশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের তালিকা করা হয়েছে। বিগত কয়েক বছরে দলের অসংখ্য নেতাকর্মী হয়েছেন অঢেল সম্পত্তির মালিক। অথচ তাদের বৈধ আয়ের উৎস বলতে তেমন কিছু নেই। রাজধানীসহ সারাদেশের এমন নেতাদের বিত্ত-বৈভবের বিবরণসংবলিত একটি গোপন প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে সম্প্রতি দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, এই প্রতিবেদন দেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘একটা মানুষের বেঁচে থাকতে কত টাকা লাগে? এরা কি টাকা কবরে নিয়ে যাবে? কেন তারা এসব করে?’ অবৈধ অর্থবিত্তশালীদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
অবৈধ পথে হঠাৎ বিত্তশালী হওয়াদের তালিকায় কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রিসভার কয়েক জন সদস্য—এমনকি জেলা, উপজেলা, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদেরও নাম রয়েছে। অবৈধ অর্থ-বিত্ত-প্রতিপত্তি, বিলাসী জীবনযাপন আর অনৈতিক কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর যেসব নেতাকর্মী জড়িত রয়েছেন তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ক্ষমতার ছায়াবৃক্ষ আওয়ামী লীগে ঘাপটি মেরে বসে থেকে যারা ফায়দা লুটছে তাদের ব্যাংক একাউন্ট খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাদের গ্রামের বাড়িতেও খোঁজ-খবর নিতে শুরু করেছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। সরকার ও আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সরকারের নীতিনির্ধারণ পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সরকার ও দলীয় নেতৃত্বে ভারসাম্য আনার অংশ হিসেবে সারাদেশের উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদ পাবেন না এমপিরা। তৃণমূলে পাঠানো বার্তায় এমপিদের উপজেলা পর্যায়ের কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, যারা এমপি হতে পারেননি, তারা যেন নেতা হওয়ার সুযোগ পান। তবে জেলা পর্যায়ে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হতে পারবেন এমপিরা। কারণ কেন্দ্রের সঙ্গে তাদের সমন্বয় করতে হয়। অপরদিকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মহানগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে না রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। হাইকমান্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দুই অংশের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে স্থান পাচ্ছেন না দলীয় কাউন্সিলররা। থানা ও ওয়ার্ড কমিটিতে স্থান পাওয়ার সুযোগ থাকলেও শীর্ষ নেতা হতে পারবেন না তারা। প্রসংগত, সরকার থেকে দলকে যতটুকু সম্ভব আলাদা করার অংশ হিসেবে গত ২০-২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় পদ থেকে তিন মন্ত্রী, চার প্রতিমন্ত্রী ও দুই উপমন্ত্রী বাদ পড়েছেন।
সূত্র জানায়, তালিকায় নাম থাকা হঠাৎ বিত্তশালীদের বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্ত করতে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে এ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। শুধু তৃণমূল কিংবা সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরাই নন, কেন্দ্রীয় কয়েক জন নেতার বিরুদ্ধেও বিপুল সম্পদ ও অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার তথ্য এখন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে। কেন্দ্রীয় একজন নেতা, যিনি ঋণখেলাপিও বটে। তার বিপুল পরিমাণ সম্পদের খবর পাওয়া গেছে। অথচ তিনি রাজনীতি ছাড়া অন্য কিছু করেন না। আওয়ামী লীগের আরেক কেন্দ্রীয় নেতার কোনো বৈধ আয় নেই। কিন্তু তিনি বিলাসবহুল অফিস পরিচালনা করেন। তার সম্পদ প্রতিদিন জ্যামিতিক হারে বাড়ে। কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে ঐ নেতা যেমন আলোচিত ছিলেন না, তেমনি তার অর্থবিত্তও কিছু ছিল না। এখন তার অফিসকক্ষে গেলেই মানুষের পিলে চমকে ওঠার অবস্থা হয়। আওয়ামী লীগের আরেকজন কেন্দ্রীয় নেতা, যিনি তেমন কিছুই করেন না, শুধু রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করেই ধনাঢ্য হয়েছেন। দুই বছর ধরে সাভারের আশুলিয়ায় আওয়ামী লীগের এক সহযোগী সংগঠনের নেতা কোটিপতি বনে গেছেন। তিনি কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি করছেন আলিশান বাড়ি, কিনেছেন কোটি টাকার গাড়ি। তার কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নেই। এরপরও তার এত সম্পদ কীভাবে হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। অধিকাংশ জেলা-উপজেলা পর্যায়ের চিত্র অভিন্ন।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মন্ত্রিসভার কয়েক জন সদস্য মন্ত্রী হওয়ার পরে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।’ আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য জানান, যারা হঠাত্ করে ফুলেফেঁপে উঠেছেন, যারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন, তাদের সংখ্যা খুবই কম। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী এখনো রাজনীতিকে ধ্যান-জ্ঞান মনে করেন। আদর্শের চর্চা করেন এবং রাজনীতিকে মানুষের সেবা করার মাধ্যম হিসেবে মনে করেন। রাজধানীসহ সারাদেশে এ ধরনের নেতাকর্মীর সংখ্যাই বেশি। এ কারণেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও কঠোর অবস্থানে চলে যাচ্ছেন। তদন্তে যদি প্রমাণিত হয় তাদের সম্পত্তি বৈধ নয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা গ্রহণে কোনো কার্পণ্য না করা হয় সে ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দলীয় ফোরামের একাধিক বৈঠকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন, রাজনীতি একটি পবিত্র জিনিস, রাজনীতি মানুষের সেবা করার বিষয়। রাজনীতিকে কেউ যদি বিত্তশালী হওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে, তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে। কারণ রাজনীতি কলুষিত হলে সব থেকে বেশি কলুষিত হবে আওয়ামী লীগ।