কোনোভাবেই কমছে না সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের অনিয়ম ও দুর্নীতি। নতুন-পুরোনো ভবন মিলিয়ে ৫০০ শয্যার এই হাসপাতাল এখন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। হাসপাতালের অফিস সহকারী থেকে শুরু করে হিসাবরক্ষক এবং অনেক কর্মকর্তা আঙুল ফুলে কলাগাছ। এদের মধ্যে অন্যতম সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের প্রধান অফিস সহকারী মো. ইকবাল হোসেন ও তার স্ত্রী হিসাবরক্ষক রেহেনা বেগম। তাদের সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের ‘রাজা-রানি’ বলা হয়। অবৈধপথে সম্পদ বানিয়ে সুনামগঞ্জের প্রভাবশালীদের কাতারে নাম লিখিয়েছেন এই কোটিপতি দম্পতি।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হাত থেকে বাঁচতে সব সম্পত্তি স্ত্রী রেহেনা আক্তারের নামে লিখে দিয়েছেন ইকবাল হোসেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে হাসপাতালের ওপর মহলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন তিনি। তার দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সংবাদ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় হয়রানির শিকার হয়েছেন সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেডিকেল সার্টিফিকেট, পোস্টমর্টেম, ভিকটিম সার্টিফিকেট, নার্সদের বদলিসহ সব কাজেই অফিস সহকারী ইকবাল হোসেনকে ঘুষ দিতে হয়। কেউ ঘুষ না দিলে কাগজপত্র দেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। তবে স্বামী-স্ত্রী দুজনই বেশিরভাগ সময় অফিস করেন না। ইকবাল হোসেনের স্ত্রী সকালে অফিসে এসে হাজিরা খাতায় নাম লিখে বাড়ি চলে যান। ইকবাল হোসেন মাঝে মধ্যে অফিসে এলেও দুপুর ১২টার মধ্যে চলে যান বাসায়। প্রধান সহকারী হওয়ায় স্বামী-স্ত্রীর উপস্থিতি রয়েছে কাগজে-কলমে শতভাগ। কিন্তু বাস্তবে উল্টো চিত্র দেখা গেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ সদরের সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে সম্পত্তির একটি দলিল করেন ইকবাল হোসেন। দলিল নম্বর ৫০৭৪। এই দলিলের মাধ্যমে সুলতানপুর গ্রামের ০.২২ একর ধানি জমি, ০.৩২ একর বাড়ির জমি, মোহনমুকুন্দ গ্রামের ১.৩৪ একর বাড়ির জমিসহ দুই কোটি দুই লাখ ৯৭ হাজার টাকার সম্পত্তি স্ত্রী রেহেনার নামে লিখে দেন ইকবাল হোসেন।
পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি আরেকটি দলিলে মোহনমুকুন্দ গ্রামের ০.১৫৮৪ একর বাড়ির জমি ও রসুলপুর গ্রামের ০.২৩৩৪ একর জমিসহ ৪১ লাখ ৫০ হাজার টাকার সম্পত্তি স্ত্রীর নামে লিখে দেন তিনি। এই দলিল নম্বর ২৭৬।
এদিকে স্ত্রী রেহেনা বেগম ২০১৭ সালের ৯ মার্চ নিজের নামে ০.০০৮০ একর বাড়ির জমি কিনেছেন, যার মূল্য তিন লাখ পাঁচ হাজার টাকা। ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি দুই লাখ ১৮ হাজার টাকা মূল্যে সুলতানপুর গ্রামে ০.০০০৫৭ একর জমি কিনেছেন রেহেনা। একই সঙ্গে নিজের ভাইয়ের ২১ শতক জমি নিজের নামে লিখে নিয়েছেন তিনি। যার মূল্য ৩৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে বর্তমানে চার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক রেহেনা।
অপরদিকে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের সামনে ছেলের নামে আল রাফি টাওয়ার বানিয়েছেন অফিস সহকারী ইকবাল। দোতলা এই মার্কেট হাসপাতালের সামনে হলেও প্রভাব থাকায় তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামেনি স্বাস্থ্য বিভাগ। একইভাবে হাসননগর এলাকার সুলতানপুর গ্রামে সুরভী আবাসিক এলাকায় দোতলা বাড়ি বানিয়েছেন তিনি। বাড়িতে রয়েছে নামিদামি আসবাবপত্র। যে খাটে ইকবাল ঘুমান, তার দাম এক লাখ টাকা।
এছাড়া হাসননগর মাদরাসা পয়েন্ট এলাকায় একটি কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে ইকবালের। পৌর শহরের বাইরে হাছনবাহার এলাকায় ৪২০ শতক জায়গায় দুটি মৎস্য খামার করেছেন তিনি। সুনামগঞ্জ পুরোনো শিল্পকলা একাডেমির পাশে রয়েছে তার একটি দোকান।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের প্রধান অফিস সহকারী হওয়ায় সবকিছুতে হস্তক্ষেপ রয়েছে ইকবাল হোসেনের। বেতন থেকে শুরু করে নার্সদের বদলিতেও ঘুষ নেন তিনি। নার্সদের বদলি ছাড়পত্র দিতে ১০-১৫ হাজার টাকা ঘুষ নেন ইকবাল। বর্তমানে প্রায় দুই কোটি টাকার সম্পদের মালিক ইকবাল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জগন্নাথপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে রেহেনা বেগমের চাকরি হয়। পরে জগন্নাথপুর উপজেলা থেকে স্ত্রীকে প্রেষণে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে বদলি করে আনেন ইকবাল, যা চাকরির গ্রেডের মধ্যে পড়ে না। এ পর্যন্ত সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা একদিনও অফিস করেননি রেহেনা বেগম।
সুলতানপুর এলাকার বাসিন্দারা জানান, ইকবাল হোসেনের বাবা মৃত ইস্কান্দার আলী ছিলেন আইনজীবী সহকারী। একটি টিনশেড ঘর ও ১২০ শতক ফসলি জমি ছিল তার। ১৯৮৪ সালে অফিস সহকারী হিসেবে চাকরি হয় ছেলে ইকবালের। এরপর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ইকবালকে। অনেক বড় বাড়ি বানিয়েছেন তিনি। বাড়িতে নামিদামি আসবাবপত্র। একসময় গরিব থাকলেও এখন লাখ টাকার খাটে ঘুমান ইকবাল। এর মধ্যে একবার ইকবালকে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতাল থেকে বদলি করা হলে হাইকোর্টে রিট করেন। পরে বদলির আদেশ বাতিল করা হয়।
সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী মুজাহিদুল ইসলাম মজনু বলেন, সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে আতঙ্কের নাম ইকবাল হোসেন ও রেহেনা দম্পতি। দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হয়েছেন স্বামী-স্ত্রী। আমরা চাই তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করুক দুদক। তাহলে সব দুর্নীতি বেরিয়ে আসবে, ধরা পড়বে তারা।
তিনি আরও বলেন, ইকবাল হোসেন নার্সদের বদলির জন্য যেমন টাকা নেন তেমনি শ্যালক-দুলাভাই মিলে হাসপাতালের সব পুরোনো জিনিসপত্র কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করেন। এতে হাসপাতালের বড় ধরনের ক্ষতি হয়।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের প্রধান অফিস সহকারী ইকবাল হোসেন বলেন, আমি নিয়মিত অফিস করি না এটা ঠিক, কিন্তু অনিয়ম করি না। কেন নিয়মিত অফিস করেন না এমন প্রশ্নের জবাবে ইকবাল হোসেন বলেন, আপনি এসে আমার অফিস করেন। আমার ইচ্ছা হয় না তাই অফিস করি না।
দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আপনাকে এসব কিছু বলতে বাধ্য নই। এসব বিষয়ে আমি কিছুই বলতে চাই না। আপনার যা খুশি লিখে দেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের ডেপুটি সিভিল সার্জন আশরাফুল ইসলাম বলেন, ইকবাল হোসেন ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেয়া হলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে। হাসপাতালের একজন অফিস সহকারীর এত বড় দুর্নীতির খবর আমার জানা নেই। এ বিষয়ে আমি খোঁজ নেব।
সৌজন্যে- জাগো নিউজ