যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের সম্পর্কে গভীর ভাঙ্গনে চীনের অর্থনৈতিক মাথাব্যথা শুরু হলেও উত্তর কোরিয়ার জন্য কৌশলগত সুযোগ তৈরি করেছে। গত দশ দিনে মধ্যপ্রাচ্যে তেহরান-ওয়াশিংটনের তীব্র উত্তেজনায় বিশেষজ্ঞরা এমন তথ্য দিয়েছেন।
ইরানের সামরিক বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলেইমানি হত্যাকাণ্ড’র জবাবে ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে তেহরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি বাড়িয়েছে; যা উপসাগরীয় অঞ্চলের বৃহ্ত্তম তেল ক্রেতা চীনের জন্যও উদ্বেগজনক।
মধ্যপ্রাচ্যে চীনের তেল আমদানির অন্যতম উৎস সৌদি আরব এবং ইরাক। গত অক্টোবরে স্বাক্ষরিত অবকাঠামোগত একটি চুক্তির আওতায় দিনে এক লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল চীনে রফতানি করছে এ দুই দেশ। শুধু তাই নয়, ইরানের অপরিশোধিত তেলের বৃহত্তম ক্রেতাও চীন। ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত কিছু নিষেধাজ্ঞা গত বছর শিথিল করার পর দেশটি থেকে চীনের তেল আমদানি কমেছে।
চীনা কাস্টমস কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের নভেম্বরে ইরান থেকে ৫ লাখ ৩৯ হাজার ১০৬ টন তেল কিনেছে কমিউনিস্ট শাসিত চীন। যদিও একই বছরের এপ্রিলে এর পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ০৪ মিলিয়ন টন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সঙ্কট পিয়ংইয়ংয়ের জন্য বেশি রাজনৈতিক। ইরানের সামরিক বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলেইমানি হত্যাকাণ্ড ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীকে পাল্টানোর আলামত হিসেবে দেখতে পারে উত্তর কোরিয়া। যে কারণে পিয়ংইয়ং নিজেকে রক্ষায় পুনরায় পারমাণবিক কর্মসূচি চালু করতে পারে।
বুধবার চীনের রাষ্ট্রীয় দৈনিক গ্লোবাল টাইমস ট্রাম্প প্রশাসনের তীব্র সমালোচনা করেছে। চীনের অর্থনীতিকে আঘাত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইরান সঙ্কটকে ব্যবহারের অভিযোগ এনেছে এই দৈনিক। গ্লোবাল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হলো বেইজিংকে এই সঙ্কটে জড়িয়ে, এমনকি সামরিক সংঘর্ষে টেনে নিয়ে চীনের উন্নয়ন ব্যর্থ করা।
‘মার্কিন-ইরান বিরোধ এই কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ ইরান এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর অন্যতম বৃহৎ এবং ক্রমবর্ধমান জ্বালানি আমদানিকারক চীন; আঞ্চলিক বিবাদ এবং অশান্তি যেটাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।’
বিকল্প খুব সামান্যই: গত মাসে উপসাগরীয় অঞ্চলের ওমান সাগরে ইরান এবং রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ নৌ মহড়ায় অংশ নেয় চীন। দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রশাসন জেনারেল কাসেম সোলেইমানি হত্যাকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মুহূর্তে সমালোচনার বাইরে অন্যকিছু করার নেই চীনের।
সিঙ্গাপুরের পরামর্শক সংস্থা ভেরিস্ক ম্যাপলক্রফটের এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক কাহো ইউ আলজাজিরাকে বলেন, চীনের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতিতে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের অবসানের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে নতুন টানাপোড়েন এড়িয়ে চলতেই বেশি আগ্রহী চীন।
২০১৮ সাল থেকে পরস্পরের বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ দুই অর্থনীতি; তবে এই যুদ্ধের আঘাত একটু বেশিই পড়েছে চীনের শিল্প-প্রতিষ্ঠানে। গত বছরের শেষ তিন মাসে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ রেকর্ড করা হয়েছে। রফতানি এবং উৎপাদনে ভাটা পড়ায় ১৯৯২ সালের পর চীনের প্রবৃদ্ধিকে কখনই এতো তলানিতে নামতে দেখা যায়নি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান কমপ্লিট ইনটেলিজেন্সের প্রতিষ্ঠাতা টনি নাশ বলেন, একটি স্থায়ী বাণিজ্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো শক্তি বেইজিংয়ের নাও থাকতে পারে। ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাণিজ্যের বোঝাপড়ায় ইরান সঙ্কট চীনের জন্য ফ্যাক্টর হিসেবে হাজির হতে পারে।
ভেরিস্ক ম্যাপলক্রফটের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক কাহো ইউ বলেন, বাণিজ্যের আলোচনায় চীনা কোম্পানিগুলোর ইরানের সঙ্গে ব্যবসার বিষয়টিকে দর কষাকষির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেন, ওয়াশিংটন ভালো করেই জানে, ইরানের অপরিশোধিত তেলের ওপর যে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তা মেনে চলে না চীন। ইরানের সামরিক রসদের যোগানও অব্যাহত রেখেছে দেশটি।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ইরানের অপরিশোধিত তেলের ক্রয় ও পরিবহনের দায়ে গত সেপ্টেম্বরে চীনের বিভিন্ন ব্যবসায়ী, কোম্পানি এবং দুটি কসকো শিপিং করপোরেশন শাখার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে হোয়াইট হাউস।
চীনা টেলিকম জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়েকে জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনা করে ট্রাম্প প্রশাসন এই কোম্পানির বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের অভিযোগ আনে। বর্তমানে কানাডায় আইনি লড়াইরত হুয়াওয়ের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা মেং ওয়াংঝু যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যাবাসনের মুখে রয়েছেন। ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দেশটিতে ব্যবসা পরিচালনা ও প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়েছে চীনা এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর কানাডার ভ্যানকুভার শহর থেকে মেং ওয়াংঝুকে গ্রেফতার করা হয়। মেং হংকং হয়ে মেক্সিকো যাওয়ার পথে ভ্যানকুভার বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি করেছিলেন। এ সময় কানাডার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাকে গ্রেফতার করেন।
যুক্তরাজ্যের বাণিজ্যবিষয়ক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট’র গবেষণা শাখা দ্য ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) কর্মকর্তা নিক ম্যারো বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সোলেইমানি হত্যাকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের বেপরোয়া দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পেল; যা ট্রাম্প প্রশাসনের বিশ্বাসযোগ্যতাকে আরও ক্ষুণ্ন করতে পারে।
পিয়ংইয়ংয়ের জন্য দৃষ্টান্ত: বিশ্লেষকদের মতে, তেহরানের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের পদক্ষেপ পিয়ংইয়ংকে অতীতেও উদ্বেগের মধ্যে ফেলেছে এবং এবারও তার ব্যতিক্রম নেই। ২০১৮ সালে ইরানের সঙ্গে ছয় বিশ্ব শক্তির পারমাণবিক চুক্তি থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন, তখনই উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল যে, কূটনৈতিক পথ পরিহার করতে পারে উত্তর কোরিয়া।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্পের সঙ্গে সিদ্ধান্ত ছাড়াই কিম জং উনের বৈঠক শেষ হয়ে যাওয়ার পর কয়েক দফায় ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায় উত্তর কোরিয়া। ডিসেম্বরের শেষের দিকে দেশটির নেতা কিম জং উন কৌশলগত নতুন এক ধরনের অস্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক করে দেন। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, সোলেইমানি হত্যাকাণ্ড কিম জং উনকে উৎসাহিত করতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়ার এহা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক লিফ-এরিক এসলে বলেন, ইরানের শীর্ষ এক সামরিক কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের কারণে পিয়ংইয়ং তার পরবর্তী উত্তেজনার মাত্রা পুনর্বিবেচনা করতে পারে।
অস্ট্রেলীয় থিঙ্কট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান দ্য লোয়ি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত এক নোটে লিফ-এরিক বলেন, পিয়ংইয়ং এখন পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ প্রতিরোধের ন্যায্যতার প্রশ্নে ইরানের এই ঘটনাকে সামনে আনতে পারে। বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাসীন শাসক গোষ্ঠী টিকে থাকার জন্য পারমাণবিক সক্ষমতা বাড়ানোর দিকেও ঝুঁকতে পারে।
গত বছরের শেষ দিনে কিম জং উন বলেন, আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষায় স্থগিতাদেশ মেনে চলার কোনও ভিত্তি নেই। দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদসংস্থা কেসিএনএর এক প্রতিবেদনে ওয়াশিংটন গুণ্ডাদের মতো দাবি-দাওয়া পেশ করছে বলে মন্তব্য করা হয়। এতে বলা হয়, ওয়াশিংটনের গুণ্ডার মতো দাবির প্রেক্ষিতে কিম জং উন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এর জবাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত রোববার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ ইস্যুতে কিম জং উন তার প্রতিশ্রুতি রাখবেন কিনা সেটি পরিষ্কার নয়। আমি মনে করি না যে, আমাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি তিনি ভেঙে ফেলেছেন। তবে সম্ভবত তিনি প্রতিশ্রুতির খেলাপ করতে পারেন।
গবেষণা সংস্থা সিনোএনকের কোরীয় বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি রিন্না বলেন, সোলেইমানি হত্যাকাণ্ড ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্তর কোরীয় কৌশলের গতিপথ পাল্টে দিতে পারে। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির কর্মকাণ্ডের ঝুঁকি বিবেচনায় অন্যান্য দেশও ওয়াশিংটনের সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে অনীহা দেখাতে পারে। তিনি বলেন, ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের চলমান উত্তেজনায়; যারা উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত হিসেবে দেখতে চান; তারা যুক্তরাষ্ট্রকে ভালো বন্ধু হিসেবে বিশ্বাস নাও করতে পারে।