জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনের অনেক সেনা আফ্রিকার দেশ হাইতিতে অবস্থানের সময় দেশটির নারীদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে শত শত শিশুর জন্ম দিয়ে শিশুগুলোকে ফেলে চলে এসেছেন। সেসব শিশুকে এখন চরম দারিদ্র্য ও প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে কষ্টেসৃষ্টে একা হাতে লালন-পালন করছেন তাদের অসহায় মায়েরা।
জাতিসংঘ অবশ্য এর আগে হাইতি ও আফ্রিকার অন্য দেশগুলোতে মোতায়েন শান্তিরক্ষী বাহিনী সদস্যদের যৌন শোষণ, নির্যাতন ও অপকর্মের কথা স্বীকার করে নিয়েছিল। তবে হাইতির ভুক্তভোগীদের নিয়ে করা নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বিষয়টি দেশটির জন্য কত মারাত্মক সমস্যার তৈরি করেছে।
মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী সম্প্রতি নতুন এক গবেষণায় উঠে আসা তথ্যমতে, ১১ বছর বয়সী মেয়েরাও শান্তিরক্ষীদের মাধ্যমে যৌন নির্যাতনের শিকার ও গর্ভবতী হয়েছেন। শান্তিরক্ষীদের দ্বরা যেসব শিশুর জন্ম তারা এখন মারাত্মক এক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছে। সামাজিক প্রতিবন্ধকতার তাদের মায়েরাও বড় একা।
যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক সাবিনা লি ও অন্টারিওর কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিকাল সায়েন্টিস্ট সুসান বার্টেলসের এ গবেষণাটি করেছেন। গবেষকদের সেখানকার শান্তিরক্ষী বাহিনীর দ্বারা নির্যাতনের স্বীকার ২৬৫ জনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এসব তথ্য জানতে পারেন।
যারা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তারা বলছে, বিশ্বের ১৩টি দেশের সামরিক-বেসামরিক সদস্যরা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কাজ করতে হাইতিতে আসলেও যেসব দেশের নাগরিকরা হাইতির প্রাপ্ত কিংবা অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীদের গর্ভবতী করে চলে গেছেন তাদের বেশিরভাগই উরুগুয়ে ও ব্রাজিলের।
গবেষকদ্বয় লিখেছেন, সাক্ষাৎকার যাদের নেয়া হয়েছে তাদের ১০ শতাংশই বলছেন এই কথা। তার মানে প্রকৃত অর্থে সমস্যার ব্যাপ্তি কত ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়। এর আগে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছিল সামান্য অর্থ বা খাবারের বিনিময়ে শিশুদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছে এই শান্তিরক্ষীরা।
২০০৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত হাইতিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী অবস্থান করেছে। পরে সন্তান জন্মদানের পর ওই নারীরা নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েন। এক হাইতিয়ান নাগরিক বলেন, ‘আপনার হাতে কিছু পয়সা দিয়ে পেটে বাচ্চা দিয়ে গেলো।‘ দ্য কনভারসেশন ওয়েবসাইটে গবেষণার ফলাফল প্রথম প্রকাশিত হলে এ তথ্য জানা যায়।
জাতিসংঘ এর আগে স্বীকার করেছিল যে, ২০০৪ থেকে ২০০৭ সময়কালে হাইতিতে মোতায়েন শতাধিক শ্রীলঙ্কান শান্তিরক্ষী ৯ শিশুর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। কিন্তু ওই শান্তিরক্ষীদের নিজ দেশে পাঠানো হলেও তাদের কোনো সাজা হয়নি।
আইন বিশেষজ্ঞ ও ত্রাণকর্মীরা বলছেন, জাতিসংঘ ভুক্তভোগী নারী ও শিশুদের সহায়তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। কিছুদিন আগে হাইতিয়ান আইনজীবীরা এমন ১০ সন্তানের পক্ষে পিতৃত্বের দাবিতে মামলা করেছেন। তাদের একজন সিয়েনা মেরোপ সিনগি বলেন, ২০১৬ সালে এ ব্যাপারে জাতিসংঘের সহায়তা চাওয়া হলে তখন জাতিসংঘ পাশে দাঁড়ায়নি।
তিনি বলেন, জাতিসংঘকে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে। হাইতির গ্রামে বসবাস করা নারীর পক্ষে উরুগুয়ের ওই পুরুষের বিরুদ্ধে আন্তঃদেশীয় ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব নয়। গবেষকদলের অন্যতম সদস্য লি বলছেন, শান্তিরক্ষী মিশনের সদস্য রাষ্ট্রগুলোরই এখন এই মা ও তার সন্তানদের দায়িত্ব নেয়া উচিত।
বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক আরও বলেন, ‘এটা জাতিসংঘের সমস্যা নয়। এটি ব্রাজিলের সেনাবাহিনী কিংবা উরুগুয়ে সেনাবাহিনীর সমস্যা। এছাড়া জাতিসংঘও তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সেনা সদস্যদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কোনো উপায় বের করতে পারেনি।’