সকালের টেইক ফাইভ (টুলবক্স) মিটিং শেষ করার পর, জানাকি ভারাক্রান্ত মনে সব সহকর্মীকে ডাকলেন, এই আপনারা সবাই এদিকে আসেন, আমি আপনাদের কিছু বলতে চাই। টেইক ফাইভ হলো, শিপইয়ার্ডে কাজ শুরু করার আগে কর্মীদের সঙ্গে সুপারভাইজার, অফিসারদের মিটিং।
যে মিটিংয়ে সুপারভাইজার তার কর্মীদের মাঝে কাজ বণ্টন করে দেন। এটাকে টেইক ফাইভ বলার কারণ, সুপারভাইজার কর্মীদের ব্রিফিং এর সময় নিম্নোক্ত বিষয়গুলোরর দিকে খেয়াল রাখেন।
* অভিবাদন।
* কুশলাদি বিনিময় করেন। সবার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেন। কাজের ধরণ ও কাজের রিস্ক বর্ণনা করেন। কীভাবে কাজ করলে রিস্কমুক্ত কাজ করে দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে তার বর্ণনা দেন।
* সবাইকে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে কাজ বণ্টন করা।
* কাজ শেষে জায়গা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার নির্দেশনা দেন। যাতে পরিবর্তী সময় কেউ এসে কোন ধরনের দুর্ঘটনায় না পড়ে।
জানাকির কথা শুনে, সবাই জানাকিকে ঘিরে জড়ো হলো। কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছে সবাই তার দিকে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। জানাকির ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। কি বলে কথা শুরু করবে, সে বুঝে উঠতে পারছে না।
গত বিশ বছর ধরে, সে এখানে কাজ করছে। কিন্তু আজ তাকে এই অতি পরিচিত মুখগুলোকে রেখে চলে যেতে হবে তার নিজ দেশে। সে কিছুতেই ভাবতে পারছে না, আজ থেকে এদের সাথে দেখা হবে না।
মানুষ হল অদ্ভুত স্বভাবের প্রাণী। এক জায়গায় দীর্ঘদিন কাজ করলে বা বসবাস করলে সে জায়গায় মাটি, মানুষ, গাছপালা, পশুপাখি এমনকি হিংস্র প্রাণীর প্রতিও মায়া জন্মে যায়। তবে মহা পুরুষদের কোনোকিছুর প্রতি মায়া জন্মায় না। তাদের কাছে মায়া জিনিসটা তুচ্ছ।
বহুকষ্টে জানাকি বলল, শুভ সকাল সবাইকে। জানাকির এমনভাব দেখে কেউ কেউ মুখ টিপে হাসছে। কারণ এই জানাকি এতদিন এখানে রাজত্ব করেছে। কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলেনি। তার কণ্ঠে ছিল তীব্রতার তেজ। তার সামনে সবাই খুব হিসেব করে কথা বলত।
কিন্তু আজ তার একি অবস্থা! সময় কীভাবে মানুষকে পাল্টে দেয়। গতকাল যে ছিল রাজার মতো আজ সে ভীতু অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সময় মানুষকে যা শিক্ষা দেয়, দুনিয়ার কোনো পুস্তক বা স্কুল তা শিক্ষা দিতে পারে না।
জানাকির কণ্ঠে দৃঢ়তা ফিরে এল। সে খুব সহজ স্বাভাবিকভাবে বলতে শুরু করল, বন্ধুরা আজ আমি আপনাদের ডেকেছি কেন? আশাকরি আপনারা সবাই তা জানেন? উপস্থিত সহকর্মীরা নীরব সম্মতি দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করল জানি।
আজ আমার কর্মজীবনের শেষদিন। আমিও আপনাদের মতো তরুণ বয়সে এখানে যোগদান করেছিলাম। তখন আমার শরীরে তরতাজা রক্ত প্রবাহিত হত। যে কোনো কাজ অনায়াসে করে ফেলতাম। এখন আমার বয়স হয়েছে। আগের মতো কাজ করতে পারি না।
আগে আমার জ্ঞান ছিল না, কিন্তু গায়ে শক্তি ছিল। আজ আমার জ্ঞান হয়েছে কিন্তু শরীরে শক্তি নেই। উপরওয়ালা সবকিছু আমাকে একসাথে দেয়নি। যারা জ্ঞান, বুদ্ধি, দক্ষতা আর শক্তির সমন্বয় করতে পারে তারাই জীবনে সফলতা পায়। আশাকরি আপনারা জ্ঞান, বুদ্ধি, দক্ষতা আর শক্তির দিয়ে সফলতা পাবেন।
আপনারা জানেন, জ্ঞান হচ্ছে জীবনের সেই চালক, যাকে চোখে দেখা যায় না। কিন্তু যার সাহায্যে চোখ বন্ধ থাকলেও সবকিছুর সত্য রূপ দেখা স্পষ্টভাবে। তিনি উপস্থিত সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে বললেন, এই দেখেন আমি দুই হাত, দুই পা, মাথা, চোখ যেভাবে নিয়ে এসেছিলাম ঠিক সেভাবেই সুস্থভাবে ফিরে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, অনেকেই বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করতে পারে না, তাই তারা বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়ে এক প্রকার পঙ্গু হয়ে বাড়ি ফিরে। কেউবা জ্ঞান, বুদ্ধি আর দক্ষতার অভাবে অনিরাপদভাবে কাজ করে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত কারণে লাশ হয়ে ফিরে। আশাকরি আপনারা কাজের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাজনিত সমস্ত নিয়মকানুন মেনে চলবেন ।
আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ আপনারা যেভাবে সুস্থভাবে এসেছেন ঠিক সেভাবেই দেশে ফিরে যাবেন। আপনাদের জন্য আপনজনরা অপেক্ষায় আছেন। আপনাদের কিছু হলে তারা কোথায় যাবে? তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না।
বলতে বলতে তার কণ্ঠ ভারি হয়ে এল। এখন তার চোখের কোণায় কিঞ্চিৎ জল জমা আছে। হাতের উল্টো পিঠে চোখের জলটুকু মুছে উপর দিকে তাকাতেই দেখলেন উপস্থিত সহকর্মীদের অনেকেই তার জন্য ব্যথিত। সবার চোখ ছলছল করছে।
মনে মনে জানাকি সৃষ্টিকর্তার নিকট ধন্যবাদ জ্ঞাপন করল। যাক এদের মনে আমার জন্য কিছুটা হলেও ভালোবাসা আছে। মানুষ কাঁদে ভালোবাসার মানুষদের বিদায়ের সময়ই। যাকে তারা হারাতে চায় না।
একে একে সবার সাথে করমর্দন করে তিনি বিশ বছরের মায়া মমতা ত্যাগ করে তার গন্তব্যের দিকে ফিরে গেলেন। পিছনে পড়ে রইল মায়া নামক আজব জিনিসটি।
ওমর ফারুকী শিপন, সিঙ্গাপুর থেকে