মৃত্যুর পর কবরের পাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার ছোট ছেলে শেখ রাসেলের ছবি রাখার কথা বলেছেন সুনামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুস শহিদ মিয়া। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মাত্র ২০ বছর বয়সে দিনমজুর বাবা চাঁন মিয়া ও মা চন্দ্র বানুর নিষেধ উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বাড়ি ছাড়েন। এরপর ভারতের শিলং হয়ে আগরতলার লোহান বনে নেপালি বংশোদ্ভূত নুমাল শাহ নেতৃত্বে নেন গেরিলা প্রশিক্ষণ। সেখান থেকে দেশে এসে ৪ নং সেক্টরের অধীনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কুলাউড়া উপজেলার জুড়ি এলাকায় যুদ্ধে অংশ নেন। সেই সময় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে চালান বন্দুক। ঘায়েল করেন একের পর এক পাক সেনা। যুদ্ধের শেষ দিকে ৬ ডিসেম্বর কুলাউড়াকে হানাদার বাহিনী মুক্ত করতে আসেন সুনামগঞ্জে। দেশ স্বাধীন হলে ইব্রাহিমপুরে জমা দেন যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র।
যুদ্ধের পরদিন ভালো যায়নি মো. আব্দুস শহিদ মিয়ার। যুদ্ধের সময় পাক সেনাদের বোমা হামলায় হারান ছোট ভাইকে। বাবা-মাকে ঘর ছাড়া করে হানাদাররা। এ কারণে একাই জীবন শুরু করেন আব্দুস শহিদ। অনেক সংগ্রামের পর ২০০৭ সালে পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। এর আগে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। চার ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে সিলেটের ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট। বাকি তিন ছেলে এখনও পড়াশোনা করছে।
সুনামগঞ্জ মুক্ত দিবস উপলক্ষে শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) বিকেলে শহীদ জহৎ জ্যোতি পাঠাগারে যুদ্ধদিনের স্মৃতি রোমন্থন ও সম্মাননা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। সুনামগঞ্জ প্রেস ক্লাব এই আয়োজন করে।
তিনি বলেন, ‘আমি ১৪ বছর রিকশা চালিয়েছি। সুনামগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় রিকশা চালিয়ে ছেলে-মেয়েদের মানুষ করেছি। রিকশা চালানোর টাকায় বড় ছেলেকে পড়াশোনা করিয়ে পুলিশে চাকরি দিয়েছি। আজ সে ট্রাফিকের সার্জেন্ট’।
কথার এক ফাঁকে আব্দুস শহিদ কেঁদে ফেলেন। তখন তার বুকে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ছেলে শেখ রাসেলের ছবি। বলেন, ‘ঘরের সবাইকে বলে দিয়েছি আমি মরার পর যেন কবরের পাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার আদরের ছেলে শেখ রাসেলের ছবি থাকে। আমাকে কবরে নিয়ে গেলেও যেন তারা আমার পাশে থাকে’।
তিনি আরও বলেন, ২০০৫ সালে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা চালু হলেও আমি ভাতা পাওয়া শুরু করি ২০০৭ সাল থেকে। ভাতা ও ছেলের পাঠানো টাকায় আমাদের সংসার চলে। ছেলে টাকা পাঠালেও আমি রাখি না। কারণ, আমার নাতি পড়ালেখা করে মানুষ হবে। সেজন্য সেই টাকা পাঠিয়ে দেই নাতির কাছে।
এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, আমরা কোনো স্বার্থের জন্য যুদ্ধ করিনি, যুদ্ধ করেছি দেশের জন্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের যে সম্মান দিয়েছেন সেটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। আমাদের টাকার প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, ছেলে আমার সৎপথে আয় করে। সে কোনো ঘুষ খায় না। কারণ আমি মানা করেছি এসব না করার জন্য। এখন পর্যন্ত আমরা ভাঙা ঘরে থাকি, চালের উপর পলিথিন দিয়ে আমার ঘর। অনেককে এনে ঘর দেখিয়েছি, কিন্তু কেউ আমার ঘরের জন্য কিছু করেনি। সবাই আশার কথা শুনিয়েছে।
তিনি বলেন, কিছু টাকা দিয়ে কবরের জায়গা কিনব বলে পরিকল্পনা করেছি। আমার কবরের পাশেই থাকবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার ছোট ছেলে শেখ রাসেলের ছবি। তাদের আমি খুব ভালোবাসি। পরে সুনামগঞ্জ প্রেস ক্লাবের পক্ষ থেকে সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান ও উত্তরীয় পরিয়ে দেয়া হয় মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুস শহিদ মিয়াকে।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সুনামগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি পংকজ কান্তি দে, সাধারণ সম্পাদক একেএম মুহিম, কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য দেওয়ান ইমদাদ রেজা চৌধুরী ও লতিফুর রহমান রাজু।
এর আগে বিকেলে সুনামগঞ্জ মুক্ত দিবস উপলক্ষে জেলা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গকারী বীর শহীদদের স্মরণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়।