কার্গো বিমানে করে পেঁয়াজ আমদানির ঘোষণায় থমকে দাঁড়িয়েছে দেশের পেঁয়াজের বাজার। আড়ত, পাইকারি কিংবা খুচরা বাজার কোথাও ক্রেতা নেই। মজুত করা পেঁয়াজ যে যার মতো করে বিক্রি করে দেয়ার চেষ্টা করছেন। ফলে সব বাজারেই পেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করেছে। পাইকারি বাজারে আগের দিন যেখানে ২২০ থেকে ২৪০ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল সেখানে গতকাল বিক্রি হয় অন্তত ২০ টাকা কমে।
খুচরা বাজারে আগের দিন ২৬০ থেকে ২৭৫ টাকা কেজিদরে বিক্রি হওয়া দেশী পেঁয়াজ গতকাল বিক্রি হয় ২৩০ থেকে ২৪০ টাকায়। দেশী হাইব্রিড পেঁয়াজ ২০০ এবং মিসরের পেঁয়াজ প্রতি কেজি ১৮০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। তবে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকগুলোর সামনে গতকালও যথারীতি উপচেপড়া ভিড় লক্ষ করা যায়। এ সময় নি¤œআয়ের মানুষদের দুই থেকে তিন ঘণ্টা লাইন ধরে ন্যায্যমূল্যের পেঁয়াজ কিনতে দেখা যায়।
দেশের প্রধান বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, পেঁয়াজ নিয়ে সারাদিন অপেক্ষা করেও তারা ক্রেতার দেখা পাননি। একেক দোকানে সারা দিনে যে পরিমাণ পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে অন্য সময় এক ঘণ্টায়ই তারচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। আগের দিন যেখানে ২০০ থেকে ২১০ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল, সেখানে গতকাল দেড় শ’ টাকায়ও ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে মন্তব্য করেন খাতুনগঞ্জের একজন আড়তদার। পাড়া-মহল্লার দোকানে তো এক সপ্তাহ ধরে পেঁয়াজ বিক্রিই বন্ধ। ভ্যানে করে যারা বিক্রি করতেন তাদের অনেকেই গতকাল ভ্যানে পেঁয়াজ তোলেননি। বিক্রেতাদের আশঙ্কা, কয়েক দিনের মধ্যেই পেঁয়াজের দাম কমে যাবে। এখন বাড়তি টাকায় কিনলে লোকসান গুণতে হবে।
এ দিকে দাম কমে যাওয়ার আশঙ্কায় অনেক খুচরা বিক্রেতা গতকাল লোকসান দিয়ে পেঁয়াজ বিক্রি করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। কোথাও কোথাও নষ্ট-পচা পেঁয়াজ বিক্রি করতেও দেখা যায়। খাতুনগঞ্জে গতকাল পচা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে বস্তা প্রতি ২০০ থেকে ২৪০ টাকাদরে। যেখানে স্বাভাবিক সময়ে এক বস্তা পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৯০০ থেকে ১০০০ টাকায়। খুচরা বিক্রেতারা পাইকারি বাজারে না যাওয়ায় খুচরাপর্যায়ে গতকাল কমবেশি পেঁয়াজ বিক্রি হলেও পাইকারি বাজারগুলো ছিল নিস্তব্ধ। বিশ্লেষকদের অনুমান, সরকারের নজরদারি অব্যাহত থাকলে পেঁয়াজের দাম কয়েক দিনের মধ্যেই ১০০ টাকার কাছাকাছি নেমে আসবে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা কার্গো বিমানে করে বিদেশ থেকে যে পেঁয়াজ আনছেন সেগুলোর দাম প্রতি কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকা পড়ছে বলে জানা গেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে শনিবার জানানো হয়, মিসর থেকে কার্গো উড়োজাহাজযোগে আমদানিকৃত পেঁয়াজের প্রথম চালান ঢাকায় পৌঁছাবে আগামী মঙ্গলবার। এস আলম গ্রুপ বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করছে। এটি তার প্রথম চালান। পর্যায়ক্রমে অন্য আমদানিকারকদের আমদানিকৃত পেঁয়াজ কার্গো উড়োজাহাজযোগে ঢাকায় পৌঁছবে। এর আগে শুক্রবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো অপর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, দেশে পেঁয়াজের সরবরাহ ও মূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে টিসিবির মাধ্যমে সরাসরি তুরস্ক থেকে, এস আলম গ্রুপ মিসর থেকে, বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আফগানিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে জরুরিভিত্তিতে কার্গো উড়োজাহাজযোগে পেঁয়াজ আমদানি করবে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ বাজারে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া সমদ্রপথে আমদানিকৃত পেঁয়াজ বাংলাদেশের পথে রয়েছে, পেঁয়াজের সবচেয়ে বড় চালান খুব শিগগিরই বাংলাদেশে পৌঁছবে।
পেঁয়াজের দাম কমবে বলে আশ্বস্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রীও। শনিবার এক সমাবেশে তিনি বলেন, পেঁয়াজ বিমানে উঠে গেছে। কার্গো বিমান ভাড়া করে পেঁয়াজ আনা হচ্ছে। কাল-পরশু পেঁয়াজ এলে দাম কমে যাবে। তিনি বলেন, যাদের কারণে পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হয়েছে বা দাম বেড়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর আগে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে ১৪০ টাকায় ওঠে সেদিন গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রসিকতাচ্ছলে বলেন, পেঁয়াজ না খেলে কী হয়? সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পেঁয়াজ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। দুই-চার দিনের মধ্যে দাম কমবে। বাজার সহনীয় করতে ১০ হাজার মেট্টিক টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আরো ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে। যদিও পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতায় হতাশা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর ওই সংবাদ সম্মেলনের দু’দিন আগে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছিলেন, এই সমস্যা আরো একমাস থাকবে। তবে মিসরের পেঁয়াজ দেশে পৌঁছলে দাম কিছুটা কমতে পারে।
মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি বাড়ছে: ইউএনবি জানায়, টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দৈনিক গড় হিসেবে গত অক্টোবর মাসের তুলনায় চলতি নভেম্বর মাসে অধিক পরিমাণে পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে।
বন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা আবছার উদ্দিন জানান, চলতি মাসে শনিবার পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ১১ হাজার ৭৩২ মেট্রিক টন। দৈনিক গড়ে এসেছে ৭৬৮ দশমিক ৮ মেট্রিক টন। অন্য দিকে, অক্টোবর মাসে এ বন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছিল ২০ হাজার ৮৪৩ মেট্রিক টন বা গড়ে প্রতিদিন ৬৯৪ দশমিক ৭৭ মেট্রিক টন।
পেঁয়াজ আমদানির এ ধারা অব্যাহত থাকলে অক্টোবরের চেয়ে এ মাসে বেশি পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি হতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
টেকনাফ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপক মো: জসিম উদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বন্দরে মাত্র একদিন পেঁয়াজ আসা বন্ধ ছিল। এ ছাড়া, অন্যান্য দিন আমদানি স্বাভাবিক ছিল। এখনো আগের মতো মিয়ানমার থেকে বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ আমদানি করছেন আমদানিকারকরা। আমরা আমদানিকৃত পেঁয়াজ দ্রুততম সময়ে খালাসে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকি।’
এ দিকে টেকনাফের স্থানীয় বাজারে পেঁয়াজ কিছুটা কম দামে বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন বাজারে পেঁয়াজের দাম ডাবল সেঞ্চুরি অতিক্রম করলেও তারা মিয়ানমারের পেঁয়াজ ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন। অতিরিক্ত মুনাফার আশায় তারা অহেতুক পেঁয়াজের দাম বাড়াবেন না বলেও জানান।