দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে যারা শান্তিতে একটু শপিং করতে চান, তাদের জন্য মুজি বা ইউনিকলোর যেকোনো শাখাই হবে দারুণ পছন্দ। সাধারণত, এই দুই প্রতিষ্ঠানে ক্রেতাদের ভিড় থাকে সবসময়ই। কিন্তু বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে সেখানে কোনো ক্রেতা সমাগম একদমই কমে গেছে। কারণ হলো, জুলাইয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর বিশেষ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জাপান। এরপর থেকেই জাপানি পণ্য বয়কট করছেন ক্ষুব্ধ কোরিয়ানরা। পোশাক থেকে শুরু করে গৃহস্থালি জিনিসপত্র কিনছেন ঘরোয়া প্রতিষ্ঠান থেকে। অপরদিকে জাপানে ‘অবিশ্বস্ত’ কোরিয়ানদের নিয়ে পুরনো ধ্যানধারণা ফের জেগে উঠতে শুরু করেছে। প্রতিবেশী কোরিয়া এখনও পুরনো ইতিহাস পেছনে রাখতে পারছে না, এই অনুযোগ এখন জাপানের কূটনীতিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষদেরও। অথচ, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া- উভয়ই বেশ উদার গণতন্ত্রী রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ আঞ্চলিক মিত্র। কিন্তু দুই দেশ কিছুতেই একসঙ্গে কাজ করতে পারছে না কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছে দ্য ইকোনমিস্ট। ম্যাগাজিনটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক বিবাদ শুরু হয়েছে গত বছরের অক্টোবর থেকে। ওই সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেসব জাপানি প্রতিষ্ঠান কোরিয়ানদের বলপূর্বক শ্রমে বাধ্য করেছিল, তারা এখন ভুক্তভোগী বিবাদীদের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। জাপানের বক্তব্য হলো, এ ধরণের সকল দায়দাবি ১৯৬৫ সালে করা চুক্তির মাধ্যমে ফয়সালা হয়ে গেছে। কোরিয়ার সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের পর জাপান দাবি করেছে, কোরিয়া সরকারকে এই রায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়া এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, বিচার ব্যবস্থায় সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের ফলে দায়ী জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার পদক্ষেপ নেয় দক্ষিণ কোরিয়ার কৌঁসুলিরা। এর পরপরই জাপান জুলাইয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি রাসায়নিক রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ওই রাসায়নিক ব্যবহৃত হয় মেমোরি চিপ নির্মাণে, যা কিনা দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। এর প্রতিক্রিয়ায় পরের মাসেই দক্ষিণ কোরিয়া দুই দেশের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে বিরোধ আরও উস্কে ওঠে।
তবে এই বিরোধ শুধু একটি রায়কে কেন্দ্র করেই নয়। গত কয়েক দশক ধরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইস্যুতে বার বার উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে দুই দেশের সম্পর্কে। জাপান ১৯১০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কোরিয়াকে উপনিবেশ করে রেখেছিল। ওই সময় কোরিয়ায় জাপানি সৈন্যরা যে নৃশংসতা সংঘটিত করেছিল, তার দায় জাপান কখনই স্বীকার করেনি বা ক্ষমা চায়নি।
এ নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ানদের মধ্যে ক্ষোভ আছে। আবার এ-ও সত্য যে, দেশটির বিভিন্ন সময়ের সরকারই রাজনৈতিক সুবিধার জন্য জাতীয়তাবাদী অনুভূতি উস্কে দিতে এই ইস্যু ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। তবে সব ইস্যুর মধ্যে উপনৈবেশিক আমলে জাপানি কোম্পানিতে বলপূর্বক শ্রমদানে বাধ্য হওয়া কোরিয়ান বা জাপানি সৈন্যদের জন্য নির্মিত পতিতালয়ে যেসব কোরিয়ান নারীকে যৌনদাসী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল, তাদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের ইস্যু সবচেয়ে বিরোধপূর্ণ।
বিভিন্ন কারণে দুই দেশ মোটামুটি মিত্র হলেও এসব ইস্যু শুধু বাণিজ্য ও জাতীয় নিরাপত্তা খাতে এতদিন প্রভাব ফেলেনি। এর একটি কারণ হলো সবসময়ই দুই দেশের অভিন্ন মিত্র যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা নিরসনে ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া উত্তর কোরিয়ার অভিন্ন হুমকিও জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে দুই দেশকে এক রেখেছে।
কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এখন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মাথা ঘামাতে অতটা ইচ্ছুক নয়। ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে উত্তর কোরিয়ার স্বৈরশাসক কিম জং উনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করেছেন। ফলে তিনি উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র হুমকিকে অত বড় সমস্যা মনে করেন না। ট্রাম্প বরং কোরিয়া ও জাপানে অবস্থানরত মার্কিন সৈন্যদের ব্যয় নিয়ে বেশি চিন্তিত। ফলে দৃশ্যত তিনি জাপান ও কোরিয়ার মধ্যকার বিরোধে হস্তক্ষেপ করতে অতটা আগ্রহী নন।
উপরন্তু, জাপান ও কোরিয়া- দুই দেশেই জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনা এখন তুঙ্গে। দুই দেশের নেতাই জাতীয়তাবাদী ঘরানার। ফলে কেউই কাউকে ছাড় দিতে রাজি নন। তাই দুই দেশের বর্তমানকে সমস্যার মুখে ফেলছে পুরনো অতীত।