সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়া-জাপান বাণিজ্যযুদ্ধ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। চীন-আমেরিকা বাণিজ্যযুদ্ধে বিশ্ব অর্থনীতির যখন ভঙ্গুর দশা, তখন দক্ষিণ কোরিয়া-জাপান বাণিজ্যযুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে আরেকটা বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এর শুরুটা করেছিল জাপান। দক্ষিণ কোরিয়ায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিকের ওপর রপ্তানি-নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে। কারণ হিসেবে তারা বলেছিল, দক্ষিণ কোরিয়া উত্তর কোরিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য পাচার করছে। তাই জাপান এসব রাসায়নিক উত্তর কোরিয়ার হাতে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে, যা পরবর্তী সময়ে তাদের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে।
উল্লেখ্য, এই তিনটি রাসায়নিক (ফ্লুরিনেটেড পলিমাইড, ফটোরেসিস্ট ও হাইড্রোজেন ফ্লোরাইড) কোরিয়ার সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের জন্য অপরিহার্য উপাদান। সেমিকন্ডাক্টর হলো কোরিয়ার রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির ২১ শতাংশের বেশি রপ্তানিপণ্য। কোরিয়ার শীর্ষ কোম্পানিগুলোর দুই-তৃতীয়াংশ আয় হয় এই শিল্প থেকে।
২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার জায়ান্টটেক স্যামসাং ও এসকে হাইনিকস কোম্পানি মিলে সারা বিশ্বের প্রায় ৬১ শতাংশ মেমোরি চিপের জোগান দেয় (সূত্র: IHS Markit)। এ ছাড়া যদি শুধু সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের অবদান বাদ দেওয়া হয়, তাহলে ২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ২ দশমিক ৭ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে ১ দশমিক ৪ শতাংশ হয়ে যাবে।
এই নিষেধাজ্ঞার কিছুদিন যেতে না যেতেই জাপান কোরিয়াকে তাদের বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের তালিকা (হোয়াইট লিস্ট) থেকে বাদ দিয়ে দেয়। কোরিয়াও পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে দুই দেশের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য বিনিময় চুক্তি স্থগিত করে এবং জাপানি একপক্ষীয় নিষেধাজ্ঞাকে অন্যায় বলে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়।
এর ফলে কোরীয়দের মধ্যে জাপানবিরোধী মনোভাব তীব্রভাবে বৃদ্ধি পায় এবং কোরিয়াজুড়ে শুরু হয় জাপানি পণ্য বর্জনের হিড়িক। জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্ককে পুরোপুরি বোঝার জন্য আমাদের এর পেছনের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যেমন জানা দরকার, তেমনি এই বৈরিতার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব আলোচনা করাও জরুরি।
ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: এশিয়ার দুই অর্থনৈতিক শক্তির লড়াইয়ের শুরু সেই ১৯১০ সালে, জাপানের কোরিয়া দখলের মাধ্যমে। ১৯৪৫ সালে জাপান কোরিয়া ছেড়ে চলে গেলেও রেখে যায় দখলদারির কালো ক্ষত, যা কোরীয়রা আজও মন থেকে ভুলতে পারেনি। তাই বারবার কোরীয়দের সামনে চলে আসে দখল যুগের গণহত্যা, সেনাশাসন, কোরীয় নারীদের জোরপূর্বক জাপানিজ সেনাবাহিনীর যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার, জাপানিজ কোম্পানিতে কোরীয়দের বিনা বেতনে খাটানোসহ নানা ঔপনিবেশিক চরিত্র।
১৯৬৫ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে জাপান সম্পর্ক স্বাভাবিক করণের জন্য কোরিয়াকে এককালীন ৫০০ মিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদানের ঘোষণা করে। সেই সময়ের দরিদ্র কোরিয়ার সামরিক সরকার এই বিশাল সহায়তাকে সানন্দে গ্রহণ করে এবং সেই সঙ্গে কোরিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। যদিও পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারগুলো ওই চুক্তিকে বিতর্কিত একপক্ষীয় বলে মনে করতে থাকে। এই চুক্তির পর থেকে মূলত দুই দেশের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়।
কিন্তু কোরিয়ার বর্তমান ক্ষমতাসীন মিনজু পার্টি ক্ষমতায় আসার পর বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যা জাপান সরকারকে নাখোশ করে।
পদক্ষেপগুলো হলো:
১) জাপান বিগত পার্ক সরকারের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি হিসেবে ২০১৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্যাতিত কোরীয় নারীদের (কমফোর্ট ওম্যান) জন্য ৮ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারের একটি ফাউন্ডেশন গঠন করে। যার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের একটি সমস্যার সমাধানের পথ উন্মুক্ত হয়। কিন্তু মিনজু পার্টি ক্ষমতায় আসার পর সেটাকে ত্রুটিপূর্ণ বলে বাতিল ঘোষণা করে। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে কমফোর্ট ওম্যানদের মূর্তি প্রদর্শন করে বিশ্বে জাপানিজদের বিপক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা অব্যাহত রাখে।
২) গত বছর দক্ষিণ কোরিয়ার সুপ্রিম কোর্ট জাপানি দুটি কোম্পানিকে কলোনিয়াল যুগে জোরপূর্বক কোরীয়দের কাজ করানোর জন্য দোষী সাব্যস্ত করে ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করে। এর একটি নির্দেশনা ছিল নিপ্পন স্টিল ও সুমিতমো মেটাল কোম্পানির জন্য। এই দুই কোম্পানিকে কলোনিয়াল যুগের চারজন কোরীয় শ্রমিককে জনপ্রতি ৮৮ হাজার ৭০০ ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
আরেকটি ছিল মিতসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রির জন্য। তাদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অন্যায়ভাবে কাজ করানোর জন্য পাঁচজন কোরীয় নারীকে জনপ্রতি ৮৯ হাজার থেকে ১ লাখ ৩৩ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণসহ ছয়জন পুরুষকে জনপ্রতি ৮০ মিলিয়ন কোরীয় ওন ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। মামলার রায়ে এটাও বলা হয়, যদি ওই কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করে, তবে কোরিয়াতে তাদের কোনো সম্পদ থাকলে সেটা বিক্রি করে আদায় করা হবে।
কিন্তু জাপানিজ কোম্পানি দুটি এই ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করে। জাপান বরাবরই বলে আসছে, এসব ক্ষতিপূরণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মীমাংসা ১৯৬৫ সালের চুক্তি অনুযায়ী হয়ে গেছে। অন্যদিকে কোরীয়রা মনে করে, ওটা ছিল রাষ্ট্রীয় বিষয়ের মীমাংসা। ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের বিষয় এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
৩) এত দিন ধরে দক্ষিণ কোরিয়া তার দুই মিত্রদেশ জাপান ও আমেরিকাকে সঙ্গে নিয়ে উত্তর কোরিয়াকে সামরিকভাবে মোকাবিলা ও কোণঠাসা করে রাখার জন্য একযোগে কাজ করলেও সাম্প্রতিক শান্তি প্রচেষ্টায় জাপানকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে বলে জাপান মনে করে। উল্লেখ্য, দক্ষিণ কোরিয়া তার সবচেয়ে বড় সামরিক মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে জাপানকে পাশ কাটিয়ে কূটনৈতিকভাবে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য একের পর এক শান্তি আলোচনার চেষ্টা চালাচ্ছে।
অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব: দক্ষিণ কোরিয়া জাপানের আদলে ইতিমধ্যে বেশ কিছু জায়ান্ট কোম্পানি ও ব্র্যান্ড গড়ে তুলেছে, যা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জাপানিজ কোম্পানিগুলোকে বাণিজ্যিকভাবে চরম প্রতিযোগিতায় ফেলে দিয়েছে। যেমন নব্বইয়ের দশকের জাপানিজ শীর্ষ সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি নিপ্পন ইলেকট্রনিক ও তোশিবাকে পেছনে ফেলে দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং ও এসকে হাইনিকস এখন বিশ্বের শীর্ষ সেমিকন্ডাক্টর জোগানদাতা। এ ছাড়া গাড়ি, গাড়ির পার্টস, জাহাজ, লোহা ও পেট্রোলিয়াম শিল্পে দক্ষিণ কোরিয়া উন্নতি চোখে পড়ার মতো।
আধুনিক মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বের প্রতিটা দেশ শিরা-উপশিরার মতো একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পর্কযুক্ত। তাই এখানে একটিতে টান পড়লে বাকিগুলোতেও তার প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার এই বাণিজ্যযুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে দুটি দেশের পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতিতে।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের রিপোর্টমতে, সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার পর আগস্ট মাসের প্রথম ২০ দিনে দক্ষিণ কোরিয়ার রপ্তানি আয় কমেছে ১৩ শতাংশ এবং এটা নয় মাস ধরে টানা কমতির দিকে। এই সময়ে কোরিয়ার শীর্ষ রপ্তানিপণ্য সেমিকন্ডাক্টারের রপ্তানি কমেছে ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া কোরীয় স্টক মার্কেটে দরপতন, কোরীয় মুদ্রার মূল্যমানে ধস, বার্ষিক জিডিপি উন্নতিতে মন্থর গতিসহ বৈদেশিক বিনিয়োগ উঠিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে চলেছে।
অন্যদিকে, এই লড়াই এখন শুধু সেমিকন্ডাক্টর বাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে কোরিয়ার ভোক্তা বয়কটের দিকে গড়িয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া জাপান থেকে প্রতিবছর প্রায় ৫৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য কিনে থাকে। উল্লেখ্য, কোরীয় ভোগ্যপণ্য বাজারে জাপানি পণ্যের বিরাট জনপ্রিয়তা রয়েছে।
জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার এই বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে জাপানি জনপ্রিয় বিয়ার আশাহি, ইউনিকোলো ব্রান্ডের কাপড়, মুজি ব্রান্ডের পণ্য, টয়োটার গাড়ি থেকে শুরু করে হাজারো জনপ্রিয় পণ্যের বাজার এখন হুমকির মুখে। যদিও কর্তৃপক্ষ মনে করছে, এটা সাময়িক ব্যাপার। তারপরও যেসব জাপানি কোম্পানির কোরিয়াতে কিংবা কোরীয় কোম্পানির জাপানে সরাসরি বিনিয়োগ আছে, তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।
রয়টার্সের (সিউল) তথ্যমতে, জাপানি আমদানির ওপর নির্ভরতা হ্রাস করার লক্ষ্যে ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতা বাড়াতে ক্ষমতাসীন মিনজু পার্টি ২০২২ সাল অবধি ৭ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ওন (১ মার্কিন ডলার সমান ১২১৫ ওন) গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া দুটি দেশই ইতিমধ্যে তাদের বিকল্প বাজার খোঁজা শুরু করেছে।
জাপানের জন্য বিকল্প বাজার থেকে এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যতটা সহজ হবে, উঠতি অর্থনীতির দেশ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য ততটা সহজ হবে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। কারণ, জাপান এই তিনটি কেমিক্যালের একচেটিয়া উৎপাদক ও বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ বাজার তাদের দখলে।
এই নিষেধাজ্ঞার কারণে দক্ষিণ কোরিয়ার সেমিকন্ডাক্টর তৈরির কোম্পানি তাদের কাঁচামালের বিকল্প বাজার হয়তো খুঁজে পাবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ক্রেতাদের মধ্যে মানসম্পন্ন সর্বাধুনিক পণ্য প্রাপ্তির ব্যাপারে একধরনের সন্দেহ তৈরি হতে পারে। ফলে, শীর্ষ সেমিকন্ডাক্টর জোগানদাতা হিসেবে স্যামসাং কোম্পানি তার শীর্ষ অবস্থান ধরে না-ও রাখতে পারে।
এ সময়ে প্রতিযোগী কোম্পানি হিসেবে আমেরিকান ইন্টেল ও কোয়ালকম, মেক্রন; তাইওয়ানের টিএস ও এমসি কিংবা জাপানের তোশিবার মতো কোম্পানিগুলো তাদের ব্রান্ড ইমেজ বাড়িয়ে বাজার দখলের লড়াইয়ে কোরীয় কোম্পানি থেকে এগিয়ে যেতে পারে।
লেখক- ফাতিমা সাঈদ, পিএইচডি ক্যান্ডিডেট, সুইনবার্ন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, অস্ট্রেলিয়া।
সৌজন্যে- প্রথম আলো