আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম ও বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম ২৭ লাখ ৮০ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটারের দেশ আর্জেন্টিনা। দেশটি বিশ্বব্যাপী ফুটবলের জন্য জনপ্রিয় ও পরিচিত। ল্যাটিন আমেরিকার সর্বাধিক মুসলিম অধ্যুষিত দেশও এটি। দেশটিতে বসবাস করে ১০ লাখেরও বেশি মুসলিম।
সাড়ে ৪ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে প্রায় ২ শতাংশ মানুষ মুসলিম। এছাড়াও রোমান ক্যাথলিক ৯২ শতাংশ, প্রটেস্ট্যান্ট ২ শতাংশ, ইহুদি ২ শতাংশ এবং অন্যান্য ৪ শতাংশ জনসংখ্যা বসবাস করে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত ২০০৯ সালের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশটিতে ৭ লাখ ৮৪ হাজার মুসলিম জনসংখ্যা রয়েছে। অন্যদিকে ‘দ্য পিউ রিসার্চ সেন্টার’ ২০১০ সালে এক রিপোর্ট প্রকাশ করে তাতে আর্জেন্টিনার মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ১০ লাখ উল্লেখ করা হয়।
আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় শহর ও রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সেই সবচেয়ে বেশি মুসলিম বসবাস করে। দেশটিতে অনেক মসজিদসহ দুটি জুমায় মসজিদ, কিং ফাহাদ ইসলামিক সেন্টার, ল্যাতিন আমেরিকা ইসলামিক অরগানাইজেশন আছে।
১৯৮৩ সালে সর্ব প্রথম রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে মসজিদে তাওহিদ নামে নির্মিত হয় শিয়া মসজিদ। মসজিদটি নির্মাণে সহায়তা করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। ১৯৮৫ সালে সুন্নি মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য মসজিদ আল-আহমদ নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে আর্জেন্টিনার করর্ডোবা শহরে ২টি, মার দেল প্লাটা শহরে ২টি এবং দেশসেরা বলসনের সূফি মসজিদ নির্মাণ করা হয়।
ল্যাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের মতোই আর্জেন্টিনায় মুসলিমদের আগমন ঘটে। স্প্যানিশ উপনিবেশের সময় আর্জেন্টিনায় মুসলিমরা আসে। স্প্যাপেনিয়রা সে সময় বহুসংখ্যক কালো আফ্রিকান লোককে দাস হিসেবে আর্জেন্টিনায় নিয়ে আসে। সেসব আফ্রিকানদের মধ্যে মরক্কোর বহু মুসলিম ছিল। তাদের হাত ধরেই আর্জেন্টিনায় ইসলামের আগমন ঘটে।
এছাড়াও বিভিন্ন সময় আরব দেশ তথা বর্তমান লেবানন ও সিরিয়া থেকে অনেকে অভিবাসী পাড়ি জমান লাতিন আমেরিকার এই দেশটিতে। মূলত ওসমানি খেলাফতের পতনের পর প্রায় সাড়ে ৩ লাখ আরব অভিবাসী আর্জেন্টিনায় আশ্রয় নেয়। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল আরব খ্রিস্টান। তাদের সঙ্গে এসেছিল অনেক আরব মুসলিম। ধারণা করা হয় সে সময় প্রায় ১ লাখ মুসলিম আর্জেন্টিনায় আশ্রয় নেয়।
১৯৮৯ সালের নির্বাচনে আর্জেন্টিনায় আরব বংশোদ্ভূত কার্লোস মেনেম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন মুসলিম। ক্ষমতার লোভে ১৯৬৬ সালে ইসলাম ত্যাগ করে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে।
তার সাবেক স্ত্রী জুলিমা ইয়মার তথ্য মতে, দেশের প্রেসিডেন্ট হতেই তিনি ১৯৬৬ সালে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেন। তিনি তার শাসনামলে মুসলমানদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন। সৌদি সরকারের সহায়তায় তার আমলেই ইসলামিক সেন্টারসহ মসজিদ নির্মাণ হয়।
আর্জেন্টিনায় মুসলমানদের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ‘দ্য ইসলামিক সেন্টার অব আর্জেন্টিনা’। এটির নির্মাণ সহায়তা লাভে কার্লোস মেনেম ১৯৯২ সালে সৌদি আরব সফর করেন। সে সসময় এক রাষ্ট্রীয় চুক্তির মাধ্যমে ৩৪০০ বর্গমিটার জমির উপর সৌদি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার নির্মিত হয়। ২০০০ সালে এ মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারের কাজ শেষ হয়।
মুসলিমদের জন্য আর্জেন্টিনায় কোনো জাতিগত বৈষম্য নেই। নেই কোনো হানা-হানি। ‘দি আর্জেন্টাইন ইনডিপেনডেন্ট’- পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে ‘সিআইআরএ’-এর প্রতিনিধি আলেক্সিস আই সায়ের বলেন, ‘মুসলিমরা স্বাধীনভাবেই তাদের ধর্ম পালন করতে পারেন। সারাবিশ্বের মুসলমানরা যখন বৈষম্যের শিকার, তখন আর্জেন্টিনার মুসলমানরা বেশ ভালো আছেন। তবে এখানকার মুসলমানদের ইসলামি জ্ঞানের অভাব রয়েছে।’
আলেক্সিস বলেন, ‘নাইন-ইলেভেনের বিপর্যয়ের পর আর্জেন্টিনার মুসলমানরা কিছুটা আতঙ্কে থাকলেও তেমন কোনো সমস্যা তাদের হয়নি।’সে সময় অনেক মুসলিম নিজেদের মুসলিম হিসেবে পরিচয়ই দিত না।’
আর্জেন্টাইন মুসলিমদের চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে আলেক্সিস আই সায়ের বলেন, ‘মুসলমানরা কর্মক্ষেত্রে থাকার কারণে সবসময় ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের সুযোগ পান না। রমজান মাসে সবাই রোজা রাখারও সুযোগ পান না। তবুও আমরা ভালো আছি।’
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো- সর্বাধিক মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে যখন হিজাব পরে নারীরা জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা পাসপোর্টর জন্য ছবি তুলতে পারে না। পুরো বিশ্ব যখন হিজাব বিতর্কে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সম্মুখীন, সে সময়টিতে আর্জেন্টিনার আদালত মুসলিম নারীদের হিজাব পরিধানের অনুমতি দিয়েছে।
এমনকি ২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারি আদালতের এক রায়ে বলা হয়, ‘জাতীয় পরিচয়পত্রেও মুসলিম নারীরা হিজাব পরিহিত অবস্থায় ছবি দিতে পারবেন।’ আর্জেন্টিনার আদলত হিজাব পরাকে ধর্মীয় স্বাধীনতা হিসেবে উল্লেখ করেছে।
তবে আর্জেন্টিনায় মুসলিমদের জন্য ধর্ম পালনে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। আর্জেন্টিনার ভাষায় ইসলামি বইয়ের ব্যাপক উপস্থিতি না থাকায় ধর্ম সম্পর্কে পড়াশোনায় রয়েছে কিছু সমস্যা। ‘কাউন্সিল অন হেমসিগ্রিক অ্যাফেয়ার্স’-এর সহযোগী ভিনসেন্ট লোফাসোর মতে-
আর্জেন্টাইন মুসলিমদের সমস্যার প্রথম কারণ হলো- ‘প্রথমত তারা তাদের অনেক ইবাদত ভুলে গেছে। তারা তাদের ধর্ম সম্পর্কে জানে না। অনেকে আরবি ভাষায় সুরা-কেরাতও জানে না। এমন অনেক মুসলিম পরিবার আছে, যেখানে একজন মাত্র আরবি পারেন, বাকিরা কেবল স্প্যানিশ পারেন।’
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘মাতৃভাষা স্প্যানিশে খুব কম ইসলামি বইপত্র পাওয়া যায়, বিশেষ করে স্প্যানিশ ভাষায় কুরআন পাওয়া যায় না (কুরআনের স্প্যানিশ অনুবাদ হলেও তা সহজলভ্য নয়)’।
তৃতীয় ও শেষ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘সেখানে মাদরাসা বা ইসলামিক স্কুল ও ইসলাম প্রশিক্ষণকেন্দ্রের অভাব রয়েছে। ফলে অনেক মুসলিম স্থানীয় খ্রিষ্টধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন। এমনকি অনেকে তার মূল ধর্ম (ইসলাম) ভুলে যাচ্ছেন!’ এজন্য আর্জেন্টিনায় দাওয়াত ও তবলিগের কার্যক্রম বৃদ্ধি করা ও মসজিদ-মাদরাসা আবাদ করা অত্যন্ত জরুরি।
তারপরও আর্জেন্টিনায় মুসলিমরা জুমার নামাজসহ প্রতি ওয়াক্তের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যায় এবং নারীরাও মসজিদ ব্যবহার করতে পারে। তবে আর্জেন্টিনা সরকার মুসলিমরা যাতে তাদের ধর্মীয় কাজ সঠিকভাবে করতে পারে সেজন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
সর্বোপরি কথা হলো, ফুটবলের স্বর্গ রাজ্য আর্জেন্টিনা হোক মুসলিম উম্মাহর জন্য দাওয়াত ও তাবলিগের উপযুক্ত স্থান। ইসলামের সুশীলত শিক্ষায় আলোকিত হোক আর্জেন্টিনার মুসলমান ও অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ। আর্জেন্টিনার আকাশে উড়ুক ইসলামের পাতাকা।