মিসরের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত প্রথম বৈধ প্রেসিডেন্ট মজলুম জননেতা ড. মুহাম্মদ মুরসি ইসা আল-আইয়াতকে ২০১৩ সালে এক সামরিক অভুত্থানের মাধ্যমে তাকে অন্যায়ভাবে ক্ষমতা থেকে বহিষ্কার করা হয়। দীর্ঘ বন্দিজীবন শেষে ১৭ জুন প্রহসনের এক বিচারিক আদালতে বক্তব্য প্রদানকালে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
ড. মুহাম্মদ মুরসি ইসা আল-আইয়াত ছিলেন সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত প্রেসিডেন্ট। তিনি ছিলেন মানবিক ও নির্লোভী। তিনি তার দেশকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন।
ড. মুরসি মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে দেশকে ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশে একটি শের (কবিতা) আবৃতি করেন- ‘আমি আমার দেশে আমার পরিবার নিয়ে কষ্টে আছি, তারপরও আমি আমার দেশকে ভালোবাসি, সম্মান করি। আমার দেশ আমাকে নিয়ে যদিও তামাশায় লিপ্ত থাকে, তারপরও আমি আমার দেশকে নিয়ে গর্ব করি।’
সরল জীবনে অভ্যস্ত ড. মুরসির জীবনের কিছু অজানা দিক তুলে ধরা হলো-
>> কুরআনের হাফেজ: ড. মুহাম্মাদ মুরসি ছিলেন পবিত্র কুরআনুল কারিমের হাফেজ। স্থানীয় গণমাধ্যমের সূত্র থেকে জানা যায়, কারাগারে মুরসি পবিত্র কুরআন চেয়েছিলেন। কারা কর্তৃপক্ষ তাকে কুরআন সরবরাহ করেনি। ফলে তিনি বলেছিলেন-
‘আমি কারাগারে ওদের (কারা কর্তৃপক্ষের) কাছে কুরআনের একটি কপি চেয়েছিলাম। ওরা আমাকে কুরআন দেয়নি। কিন্তু ওরা তো জানে না, আমি তো ৪০ বছর আগেই পবিত্র কুরআন মুখস্ত করেছিলাম। আমি তো কুরআনকে একটু ছুঁতে চেয়েছিলাম। এরচেয়ে বেশি কিছু তো নয়।’
>> বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ: মুরসি ছিলেন অনেক মেধাবী ও বুদ্ধিমান। প্রকৌশল নিয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী মুরসি সবসময় গবেষণা ও অধ্যয়নে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকৌশল বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালির্ফোনিয়ায় জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
>> সাধারণ বাসায় বসবাস: প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও মুরসি ছিলেন সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। ছোট্ট একটি অ্যাপাটমেন্টে তিনি পরিবার নিয়ে থাকতেন। শুধু রাষ্ট্রীয় শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ও বিদেশি অতিথিদের সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি সরকারি মালিকাধীন ভবন ব্যবহার করতেন।
>> বোনের বিশেষ চিকিৎসা প্রত্যাহার: প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তার বোন গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে যান। চিকিৎসকরা তাকে চিকিৎসার জন্য আমেরিকা কিংবা ইউরোপে পাঠানোর পরামর্শ দেন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কখনো আমার নিজের পরিবারের জন্য চিকিৎসায় বিলাসিতা করতে চাই না। মিসরের সাধারন হাসপাতালেই তাদের চিকিৎসা হবে।’
>> আজানের প্রতি সম্মান: ইসলামের প্রতি তাঁর ছিল অগাধ সম্মান। তাই রাষ্ট্রীয়সহ যে কোনো অনুষ্ঠান চলাকালে আজান হলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি বক্তৃতা দেয়া থেকে বিরত থাকতেন।
>> গৃহহীনদের প্রতি সমবেদনা: ড. মুরসি গৃহহীন ও অসহায়দের ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। গৃহহীন বিধবা নারীর প্রতি তার সহযোগিতা ছিল তুলনাহীন। রাস্তার পাশে ঘুমিয়ে থাকা গৃহহীন নারীকে তিনি তুলে নিয়েছিলেন নিজ গাড়িতে। আবাসন ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, মিসরে কোনো মায়েরই কষ্ট পাওয়া উচিত নয়।
>> আন্তর্জাতিক সহায়তায় অংশগ্রহণ: নিজ দেশের গরিব অসহায়দের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার কাজেও সম্পৃক্ত ছিলেন ড. মুরসি। তিনি সুনামির পর তাহবিল গঠন করে ইন্দোনেশিয়া ও সিরিয়ায় অনেক সাহায্য ও সহায়তায় করেছিলেন।
>> বিশ্বের সর্বনিম্ন বেতনভূক্ত প্রেসিডেন্ট: ড. মুহাম্মাদ মুরসি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে কম বেতন-ভাতা ভোগ করা প্রেসিডেন্ট। বিশ্বজুড়ে অনেকে দেশের প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রী অঢেল সম্পদ ও টাকার মালিক হয়ে যায়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ড. মুরসি পুরো বছরের জন্য মাত্র ১০ হাজার ডলার বেতন নিয়েছেন।
>> ফজরের জামাআতে অংশগ্রহণ: তিনি কখনোই ফজরের নামাজের জামাআত ছাড়তেন না বরং নিয়মিত ফজরের নামাজের জামাআতে অংশগ্রহণ করতেন। ফজরের জামাআতে অংশগ্রহণকারীরা নিয়মিতই তাকে ফজরের জামাআতে উপস্থিত হতে দেখতেন।
>> ছবি তুলতে অনীহা: ছবি তোলার প্রতি তার ছিল চরম অনীহা। তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানসহ যে কোনো কাজে যতটা সম্ভব ছবি তোলা থেকে নিজেকে বিরত রাখতেন। তাইতো বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে ধর্মীয় স্কলাররাও তার জন্য দোয়া করেছেন। তার মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন।
এদিকে গত মঙ্গলবার জর্ডানের সাবেক রানি নূর আল হুসাইন তার ব্যক্তিগত টুইটারে মুরসির প্রশংসা করে লেখেন- ‘তার কিসের চিন্তা? নিশ্চিন্তে প্রশান্তির ঘুম ঘুমাক সে, তিনিই মিসরের সর্বপ্রথম এবং একমাত্র গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট।’ আল্লাহ তাআলা মজলুম জননেতা ড. মুহাম্মদ মুরসি ইসা আল-আইয়াতকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।