বাংলাদেশী ভাষা-সংস্কৃতি, ধর্ম-বর্ণসহ নানা ধরনের সংস্কার ও জাতিগত ভেদাভেদ ভুলে প্রেম-ভালোবাসার টানে বাংলাদেশে ছুটে আসছেন অনেক বিদেশী তরুণী। এটি এখন বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয়ের সূত্র ধরে ঘর ছেড়েছেন ভালোবাসার টানে।
সকল ভেদাভেদ ভুলে সাত সাগর তের নদী পাড়ি দিয়ে উড়ে এসেছেন বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে। ভালোবাসার টানে ঘর ছাড়ার ঘটনা সমাজে অহরহ ঘটলেও বর্তমান যুগে দেশ ছাড়ার বিষয়টি যুক্ত হয়েছে। বিষয় গুলো মিডিয়ার বদৌলতে আলোচিত হয়েছে। অনেকেই প্রেমের টানে দেশ ছাড়লেও হয়নি কোন সংসার।
আবার অনেকেই স্ত্রীর সাথে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে চুটিয়ে করছে সংসার, হয়েছে সন্তান। সুখের কাটছে তাদের দাম্পত্য জীবন। বিদেশ থেকে পাড়ি জমিয়ে প্রেমের টানে বাংলাদেশে আসা এরকম কয়েকজন দম্পত্তির খোঁজখবর নিয়ে তুলে ধরছি পাঠকদের উদ্দেশ্যে।
ব্রাজিল থেকে রাজবাড়ী: ব্রাজিল কন্যা জেইসা ওলিভেরিয়া সিলভা। তার সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় ঘটে রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার জামালপুর গ্রামের বাসের সুপারভাইজার সঞ্জয় ঘোষের সাথে। মাত্র দেড় বছরের পরিচয়ের সূত্রধরে দু’জনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রেমের টানে ২০১৭ সালের ৩ এপ্রিল ছুটে আসে বাংলাদেশে জেইসা। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি জেইসাকে নিজ গ্রামের বাড়ীতে তোলে প্রেমিক সঞ্জয়।
বিষয়টি এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে উৎসুক জনতার ঢল নামে। জনতার ভীড় সামাল দিতে হিমসীম খেতে হয় ওই পরিবারের। প্রশাসনের সহযোগিতায় কয়েকদিন বালিয়াকান্দি উপজেলার জামালপুর গ্রামের বলাই ঘোষের ছেলে ঢাকা-কলকাতা শ্যামী পরিবহনের সুপারভাইজার সঞ্জয় ঘোষের বাড়ীতে অবস্থান করেন জেইসা। সেখানে পারিবারিক সম্মতিতে তারা দু’জনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জেইসা সরকারী চাকুরীজীবী হওয়ার কারণে সপ্তাহ খানেক বাংলাদেশে অবস্থান করার পর সঞ্জয়কে ব্রাজিলে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ২০১৭ সালের ১০ এপ্রিল ব্রাজিলে ফিরে যাওয়ার জন্য জেইসা বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। তবে এখন পর্যন্ত সঞ্জয় ব্রাজিলে যেতে পারেনি।
এ বিষয়ে সঞ্জয় ঘোষের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আশা করছি খুব শীঘ্রই ব্রাজিল যেতে পারবো। কাগজপত্রের অনেক ঝামেলা থাকার কারণে এতদিন দেরী করতে হলো।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফরিদপুরে: প্রেমের টানে গত বছরের ৬ এপ্রিল ঢাকায় আসের যুক্তরাষ্ট্রের নারী শ্যারন খান। তিনি ফরিদপুরের ছেলে আশরাফ উদ্দিনের কাছে এসেছিলেন। আশরাফ ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুর ইউনিয়নের ঝাউখোলা গ্রামের মোঃ আলাউদ্দিন মাতুব্বরের ছেলে। আশরাফ ঢাকার কবি নজরুল ইসলাম কলেজের ইংরেজি বিভাগের মাষ্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। তার বাবা পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের গাড়ী চালক। পরিবারটি থাকে ফরিদপুর নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্টাফ কোয়াটারে।
আমেরিকান মুসলিম ব্যাংকের চাকুরে শ্যারন খানের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় ঘটে। এক বছরের পরিচয় ও ৬ মাসের প্রেমের সম্পর্কে বাংলাদেশে আগমন এবং ১০ এপ্রিল বিয়ে করেন। ২১ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং আশরাফকেও নিয়ে যান। তাদের ঘরে একটি পুত্র সন্তান হয়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ আর যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগলিক দুরত্ব কমিয়ে মার্কিন তরুনী এলিজাবেথ এসলিক ছুটে আসে ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার রাখালগাছি গ্রামের মিঠুন বিশ্বাসের বাড়ীতে। অবশেষে খ্রিষ্টান ধর্মের বিধান অনুযায়ী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এলিজাবেথ ও মিঠুন। ২০১৫ সালের মে মাসে ফেসবুকে তাদের পরিচয়। দীর্ঘ আড়াই বছরের সম্পর্কের পর তারা দু’জনে বিয়ে করেন। পরে দেশে ফিরে গেলেও মিঠুন এখন যাওয়ার অপেক্ষায় আছে।
মালয়েশিয়া থেকে চুয়াডাঙ্গা: প্রেম মানে না বয়স। প্রেমের টানে ৪০ বছর বয়সী মালয়েশিয়ান ইসহারি ২১ বছর বয়সী তার প্রেমিক চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার ফরিদপুর গ্রামের ইউনুছ আলীর ছেলে জহুরুল ইসলামের বাড়ীতে ওঠেন। তার সাথে মালয়েশিয়ায় জহুরুল ইসলামের পরিচয় ঘটে। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক থাকায় জহুরুল বাংলাদেশে আসায় তিনিও ছুটে আসেন। পরে মালয়েশিয়া ফিরে যান।
কাজের সন্ধানে ব্রাক্ষ্রনবাড়িয়া জেলার কসবা থানার মন্দিবাগের আশিকুর রহমান আশিক ২০১৩ পাড়ি জমান মালয়েশিয়া। সেখানে পরিচয় ঘটে মালয়েশিয়ার নাগরিক ফাতেমার সাথে। সে কুয়ালালামপুরে একটি কলেজের ছাত্রী। তার ভালোবাসার টানে বাংলাদেশে আসে এবং তাকে বিয়ে করে। পরে মালয়েশিয়া পাড়ি জমায়।
ফেসবুকে মাত্র ৬ মাসের পরিচয়ে টাঙ্গাইলের সখিপুর উপজেলার কলেজ ছাত্র মনিরুল ইসলামের ভালোবাসা মালয়েশিয়া থেকে এক মাসের ভ্রমন ভিসায় ছুটে আসেন মালয়েশিয়ান নাগরিক জুলিজা। পরে বিয়ে না করেই পারিবারিক কারণে মালয়েশিয়া ফিরে যান জুলিজা।
থাইল্যান্ড থেকে নাটোর: থাইল্যান্ডে বহু বিবাহ। তার পছন্দ ছিল না এটি। তাই বিয়েও করছিল না। হঠাৎ করেই ফেসবুকে পরিচয় ঘটে অনিক খানের সাথে। ওর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে থাইল্যান্ড থেকে ছুটে আসে সুপুত্তো ওরফে ওম ওরফে সুফিয়া খাতুন। ২২ বছর বয়সী অনিক খানের সাথে বিয়ে করেন বাংলাদেশে ছুটে এসে ফাস্টফুড ব্যবসায়ী ৩৬ বছর বয়সী সুফিয়া। তারা এখন থাইল্যান্ডে বসবাস করছে।
পোল্যান্ড থেকে রাজারবাগ: ফেসবুকের মাধ্যমে বাংলাদেশী ছেলে লন্ডনে পড়াশোনা করতে যাওয়া ঢাকার রাজারবাগের শামীম আহম্মেদের সাথে পরিচয় ঘটে স্যান্ড্রা পোল্যান্ডের অধিবাসী ক্যাটরিনার। ওই দেশে অবৈধভাবে থাকতে পারছিল না শামীম। ক্যাটরিনার সহযোগিতায় দেশে ফেরে শামীম। জুলাইয়ের ১ তারিখে তার বাংলাদেশে আসার কথা থাকলেও না আসায় সবাই ভেবেছিল আসবে না। কিন্তু আগষ্টে বাংলাদেশে আসে ক্যাটরিনা স্যান্ড্রো ও তাকে বিয়ে মুসলমান হয়ে। তারা এখন দু’জনই লন্ডনে।
অস্টেলিয়া থেকে বরিশাল: প্রেমের টানে অস্টেলিয়া থেকে পরিবারের ১৮ জন সদস্য পিতা, মাতা, ভাই-বোন, খালা-খালু, ফুফু-ফুফাসহ বরিশালের আলেকান্দা এলাকার শামসুল আলম বাবুলের ছেলে সাইদুল আলম রুমানের বাড়ীতে ওঠেন। পরে ধর্মান্তরিত হয়ে রুমানকে বিয়ে করেন। তাদের সংসার সুখেই চলছে অস্টেলিয়ায়।
অস্টেলিয়া থেকে পরিচয়ের সুত্রধরে মাগুরায় শহরে এসে ক্যাথরিন নামের অস্টেলিয়ার নাগরিক তার প্রেমিক কাজী মারুফুজ্জামান চন্দনকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারও ভালোই চলছে।
আয়ারল্যান্ড থেকে বিয়ানী বাজার: ২০০৯ সালে বিয়ানী বাজার উপজেলার ঘুঙ্গাদিয়া গ্রামের বাসিন্দা তাজ উদ্দিনের ছেলে মাহবুবুর রহমান আয়ারল্যান্ড যাওয়ার পর ডা. ইফা রায়ানের সাথে পরিচয় ঘটে। পরে বাবা-মা, ভাইদের নিয়ে বিয়ানী বাজারে এসে লাল বেনারশি পড়ে বিয়ের পিড়িতে বসে। পরে স্বামীকে নিয়ে আয়ারল্যান্ড পাড়ি জমায়।
রাশিয়া থেকে শেরপুর: শেরপুরের নলিতাবাড়ী উপজেলার সন্যাসীভিটা গ্রামের ধীরেন্দ্র কান্ত সরকারের ছেলে ধর্মকান্ত সরকার। ১৯৯৭ সালে পড়ালেখার জন্য রাশিয়া যান। সেখানে তার সাথে পরিচয় ঘটে সিভেতলেনা। প্রেমিকের টানে বাংলাদেশে ছুটে এসে সনাতন ধর্মানুসারে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তারা দু’জনই রাশিয়া পাড়ি জমান।
ভিয়েতনাম থেকে চাঁদপুর: চাঁদপুরের শহরাস্তি উপজেলার পৌর শহরের ৮নং ওয়ার্ডের নদের বাড়ির মোবারক হোসেনের ছেলে মোঃ আলমগীর হোসেন। ১০ বছর আগে জীবন ও জীবিকার তাগিদে মালয়েশিয়া পাড়ি জমান। সেখানে তার সাথে পরিচয় ঘটে ভিয়েতনাম নাগরিক টিউ থিতুর সাথে। প্রেমের টানে বাংলাদেশে এসে দুজন ঘর বাঁধেন।
চীন থেকে চাদপুরে: চাকুরী সুত্রে দুবাইয়ে চীনা নাগরিক ইবনাত মরিয়ম ফাইজার সাথে নেত্রকোনার কলমাকান্দার গুতুরা বাজারের জসিম উদ্দিনের সাথে। মাঝে ৩ বছর চাকুরীর কারণে দু’জন দু’দেশে চলে যায়। পরে দু’জন দুবাইয়ে দেখা করেন। তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ফাইজা খ্রিষ্টান ধর্মত্যাগ করে মুসলমান ধর্মগ্রহন করে জসিমকে বিয়ে করেন। গত রোববার নেত্রকোনার কলমাকান্দার গুতুরা বাজারের আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম আজাদের বাড়ীতে বিবাহোত্তর বৌভাতের আয়োজন করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের বিয়ে হয় দুবাইতে।
জার্মানি থেকে খুলনায়: প্রেমের টানে স্বামী-সংসার ফেলে জার্মান গত ১০ জুন খুলনায় চলে আসছেন অ্যাসটিট ক্রিস্টিয়াল কাসুমী সিউর, ইসলাম গ্রহণ করে ইতিমধ্যে বিয়েও করছেন খুলনার যুবক আসাদ মোড়লকে। আসাদের সঙ্গে জার্মান নাগরিকের বিয়ের খবরে এলাকাবাসীর মধ্যে কৌতূহল ছড়িয়ে পড়েছে।
জানা যায়, মহানগরীর যোগিপোল ৭নং ওয়ার্ডের ইব্রাহিম মোড়লের ছেলে এমডি আসাদ মোড়লের (৪০) সঙ্গে দুই বছর আগে ফেসবুকে পরিচয় হয় জার্মানির ক্রিস্টিয়ালের (৪৩)। বন্ধুত্ব থেকে একপর্যায়ে দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ক্রিস্টিয়াল এই সম্পর্ককে বাস্তবে রূপ দিতে জার্মানির স্বামীকে ডির্ভোস দিয়ে গত ১০ জুন ঢাকায় আসেন। ১১ জুন তিনি আসাদের খোঁজে খুলনায় আসেন এবং একটি হোটেলে ওঠেন। ওই হোটেলেই দুজনের প্রথমবারের মতো সরাসরি দেখা হয়। ১২ জুন ক্রিস্টিয়াল খুলনা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ১৩ জুন কোর্টের মাধ্যমে দুজনের বিয়ে হয়।
ফেসবুকের বদৌলতে বিদেশী তরুণীরা সামান্য কিছু দিনের পরিচয়ের সূত্রধরেই ছুটে আসছে বাংলাদেশে। বিয়ে করে কিছুদিন থাকার পরই ফিরে যাচ্ছে নিজ দেশে। আবার কেউ কেউ স্বামীকে নিয়েই উড়াল দিচ্ছে। কারো কারো সাথে যোগাযোগ আছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না।