প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির সমীকরণে প্রতিনিয়ত যুদ্ধে টিকে থাকতে হচ্ছে প্রবাসীদের। পরিবারের সুখের আশায় বছরের পর বছর বিদেশে পড়ে থাকতে হয় তাদের। দেশে থাকা পরিবার পরিজনদের আকাশচুম্বী চাওয়া-পাওয়ার অনেকটাই নির্ভর করে প্রবাসীদের উপার্জনের ওপর। 2 তাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে যাচ্ছে দেশকে।
কেউ কেউ পরিবারের মুখে হাসি ও স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনলেও অনেকেই প্রবাসে অসহায়ত্বের গ্লানি টানছেন। পদে পদে তারা ফাঁদ পেতে থাকা প্রতারকদের দ্বারা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। অবৈধতার অভিশাপ নিয়ে প্রবাসে থাকার ইচ্ছে না থাকলেও নামধারী কিছু প্রতিষ্ঠান আর দালালদের খপ্পরে পড়তে হচ্ছে অনেকেই। অথচ দেশ গড়ার পিছনে এ সারথিদের রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা।
গতকাল ছিল পহেলা মে। মে দিবসের দিনে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. তুন মাহাথির মোহাম্মদসহ মন্ত্রিসভার সবাইকে কাজ করতে হয়েছে। মালয়েশিয়া সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রণালয়ে বন্ধের দিনেও কাজ করেছেন। মে দিবসে ছিল ছুটির দিন। ছুটি না নিয়ে বিদেশি কর্মীরা যার যার অবস্থানে থেকে কাজ করেছেন। তাদের একটাই কথা পরিবার পরিজন ছেড়ে বিদেশে এসেছি টাকা রোজগার করতে। বসে থাকলে একদিনের মজুরি পাব না। তাই কাজ করেছেন অনেকে।
ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট গত জুনে দেশের ১১টি সেক্টরে ১,৭৮১,৫৯৮ নথিভুক্ত অভিবাসী কর্মীদের রেকর্ড করেছে। ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, নেপাল এবং মিয়ানমারের এই শ্রমিকরা প্রধানত নির্মাণ ও রোপন শিল্পের পাশাপাশি রেস্তোরাঁয় কাজ করছেন।
তারা তাদের দেশে থাকা পরিবারের মুখে হাঁসি ফোটাতে স্ব-সাহসে কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন। কিন্তু এখানে সবাই ভালো জীবন খুঁজে পায় না, কারণ কখনও কখনও তারা শোষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাজ করছে।
মালয়েশিয়া উন্নত জাতিগত অবস্থার প্রতি পরিবর্তনের ফলে, আকাশচুম্বী এবং কাঠামোগুলো আকাশমন্ডুলকে ডুবিয়ে দিচ্ছে, এই আকাশচুম্বি কাঠামোগুলো বেশিরভাগই এই শ্রমিকদের নির্মিত বলে মন্তব্য করেছেন একজন মালয়েশিয়ান নাগরিক।
বাংলাদেশি বাহরুন, ২৬, কুয়ালালামপুরে একটি ল্যান্ডমার্ক প্রকল্পে কাজ করেন। ছয় বছর আগে একটি নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করছেন। তিনি বলেন, বিদেশ আবার ছুটি। এসেছি টাকা ইনকাম করতে। তানজোং কারং এ কৃষি মূলত বিদেশ থেকে বিদেশে শ্রম দ্বারা চালিত হয়।
এখানে কাজ করছেন বাংলাদেশিরা।
মোসেন মুহম্মদ, ২৮, সুলতান আব্দুল সামাদের সামনে লেনটি পরিচ্ছন্নের কাজ করছেন। ভালই চলছে তার। মাস শেষে বাড়িতে টাকা পাঠাচ্ছেন এটাই তার আনন্দ। বাংলাদেশ থেকে আসা, মোহসিন ও আলী প্রাথমিকভাবে কৃষি কাজ করতেন। কিন্তু ভালো বেতন অনুসন্ধানে কুয়ালালামপুরে চলে আসেন। এখন তারা ভাল বেতনে কাজ করছেন।
অনেকেই ৬৩ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করার কথা, কিন্তু বাংলাদেশি আলী মহসেন এখনও সেগাম্বুতের টিভি ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি মেরামতের কাজ করছেন।
২০১৬ সালে দেশটিতে কর্মরত অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতার ঘোষণা দেন মালয়েশিয়া সরকার। ধাপে ধাপে সময় বাড়িয়ে দীর্ঘ আড়াইটি বছর চলে বৈধকরণ প্রক্রিয়া। এই সময়ের মধ্যে জন্ম নিল অনেক প্রতারকের। ফিটফাট অফিস বানিয়ে বৈধ করে দেয়ার নামে খেটে খাওয়া অবৈধ কর্মীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে উধাও হয়েছে প্রতারকরা। আবার কেউ-কেউ ফোনে হুমকিও দিচ্ছে।
মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বৈধ হওয়ার জন্য এসব প্রতারকদের হাতে অর্থকড়ি আর পাসপোর্ট তুলে দিলেও তাদের কপালে জোটেনি বৈধতা। এসব অবৈধদের সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজারেরও বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারা এখন ইমিগ্রেশন এবং পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ওই প্রতারকরা একজন অবৈধ কর্মীকে সিটিং এবং ফিটিং করে তাদের মাধ্যমে বৈধ হওয়ার জন্য। যখন তার ফাঁদে পড়ল তখনই শুরু করে দিল মারিং-কাটিং।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মালয়েশিয়া সরকার অবৈধ কর্মীদের বৈধ করার জন্য দুটি প্রোগ্রাম চালু রেখেছিল। একটি হচ্ছে রি-হিয়ারিং অন্যটি হচ্ছে ই-কার্ড। এ দুটি প্রোগ্রামকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল শক্তিশালী একটি মিডলম্যান চক্র। বৈধ হওয়া ও মালিকের কাছে কাজ পাওয়া, সব জায়গাতেই এ চক্রকে টাকা দিয়ে টিকে থাকতে হতো কর্মীদের। কর্মীদের বৈধ করে দেয়ার নামে ৫-১০ হাজার রিঙ্গিত জনপ্রতি হাতিয়ে নিয়েছে।
বাংলাদেশি অবৈধ কর্মীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন তাদের বৈধ করে দেয়ার নামে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্মীদের বৈধ করতে পারেননি। কর্মীদের টাকাও ফেরত দিচ্ছেও না। উল্টো কর্মীদের পুলিশের ভয় দেখানো হচ্ছে। এভাবে এ চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে থাকতে হচ্ছে কর্মীদের।
এ ছাড়া মালিক তাদের অর্ধেক মজুরিতে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। আবার বৈধতার নামে টাকা নিচ্ছে। ফলে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে মাস শেষে নিজে খেয়ে পরে বাঁচতেই কষ্ট হচ্ছে অবৈধ কর্মীদের। মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মুহা. শহিদুল ইসলাম বলেন, প্রায় ১০ লাখের অধিক বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় রয়েছেন। প্রতিদিন একভাগ লোক সমস্যায় পড়লে ১০ হাজার হয়। আর ১০ হাজার লোকের সমস্যা সমাধান করতে ১৫ মিনিট করে ব্যয় হলে ১৫-২০ দিন সময় লাগে। অতএব অভিযোগ থাকতেই পারে। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে দূতাবাস অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে। এ ছাড়া প্রতারণার শিকার হয়েছে, তাদের বৈধকরার প্রক্রিয়া চলছে।
তাদের রেমিট্যান্স পাঠানো সহজীকরণ, নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্র এবং বিদেশ ফেরতদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা চালু করতে হবে। ফলে দেশের সম্পদের সুষ্ঠু পরিচর্যা হবে। রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাবে। দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।
সৌজন্যে- জাগো নিউজ