Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

noyonবিভিন্ন দেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরা প্রবাসীদের (নারী-পুরুষ) কাছে তিনি ‘নয়ন ভাই’ নামেই পরিচিত। পুরো নাম আল আমিন নয়ন। ২০০৭ সালে স্বপ্ন পুরনে পাড়ি জমিয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়। কিন্তু, স্বপ্ন পূরণ তো দূরের কথা রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসতে হয় তাকে। তবে হতাশ হননি নয়ন। নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে চলেন সামনের দিকে। প্রতারিত হয়ে বিদেশ ফেরা বাংলাদেশীদের হতাশাও দূর করার দায়িত্বপালনে এগিয়ে আসেন তিনি। ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের হয়ে কাজ করছেন বিদেশে গিয়ে প্রতারিত হয়ে দেশে ফেরা নারী-পুরুষদের জন্য। হয়ে উঠেছেন প্রবাসীবন্ধু। তার প্রবাসীবন্ধু হয়ে ওঠার গল্প শুনিয়েছেন পাঠকদের কাছে। নয়নের সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন নাজমুল ইসলাম।

সম্প্রতি নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসা নারীকর্মীর সংখ্যাটা বেড়েছে। নয়ন বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচিতে ২০১৭ সাল থেকে তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে এই নারীদের জরুরি সহায়তা দেওয়ার কাজ করছেন। আলাপচারিতায় আল-আমিন জানালেন, তিনি নিজেও মালয়েশিয়ায় গিয়ে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তাঁর জীবন পুরোটাই অনিশ্চয়তায় ঢেকে যায় উঠতি বয়সে।

chardike-ad

আল-আমিনের বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায়। ২০০৭ সালে আল-আমিন অন্যদের মত বড় স্বপ্ন নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার বায়না ধরেন পরিবারের কাছে। ছেলের স্বপ্নের কথা বিবেচনা করে তাঁর বাবা তাঁকে মালয়েশিয়া পাঠিয়েছিলেন।

আল-আমিনকে দালাল জানিয়েছিলেন, সনি ইলেকট্রনিকস কোম্পানিতে চাকরি হবে। বেতন ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। পাসপোর্ট ও সরকারি ছাড়পত্র নিয়েই তিনি মালয়েশিয়ায় যান।  কিন্তু যাওয়ার পরেই বুঝতে পারেন, তিনিসহ অন্যদের আসলে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে দু‘দিন থাকার পর বিমানবন্দর থেকে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখা হয় একটি গুদাম ঘরে। গিয়ে দেখে তাদের মত অনেকেই একইভাবে প্রতারণার শিকার।

এক পর্যায়ে আল আমিন নয়ন সহ ৬জনকে তামিল এক মালিকের অধীনে গহীন জঙ্গল  নিয়ে যাওয়া হয়। কাজ করতে দেয়া হয় জঙ্গল পরিষ্কারের। সাপ, ব্যাঙ, কেঁচো—উপদ্রব সবই সহ্য করতে হতো। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরণা থেকে খাওয়ার পানি আনতে হতো। এক সময় আর সহ্য করতে না পেরে ছয়জন আত্মহত্যার হুমকি দেন। বাধ্য হয়ে তাদের নেওয়া হয় একটি গুদাম ঘরে। যেখানে গিয়ে আরো  বহুজনকে পান।  এখানে কাটতে থাকে তাদের বন্দী জীবন। আগে থেকেই একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য পরিবারের নম্বর সংগ্রহ রেখেছিলেন তারা। তাই একদিন এক যোগে বিভিন্ন জায়গায় থাকা শ্রমিকরা জানালা ভেঙে আল-আমিনসহ ১১০ জন পালিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে  যান। প্রতারণার বিচারসহ দেশে ফেরার জন্য সহায়তা চান। কিন্তু,  তাদের খুব বেশি লাভ হয়নি।

প্রায় সাত মাস বেতন ছাড়া, আশ্রয় ছাড়া মানবেতর জীবন কাটাতে হয়। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শ্রমিকেরা দূতাবাসের সামনে অনশনসহ বিভিন্ন আন্দোলনে নামেন। এ সময় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই আন্দোলনের খবর বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। অবশেষে তানাগানিতা নামের একটি মানবাধিকার সংগঠনের সহায়তায় ৮০ জন খালি হাতে শুধু প্রাণ নিয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসতে সক্ষম হন।

কিন্তু, ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা এজেন্সিকে দিয়ে বিদেশ যাওয়া এসব মানুষ সেই টাকা ফিরে পেতে দেশেও বেগ পেতে হয়। টাকা ফেরত পাওয়ার সংগ্রামে মূল ভূমিকায় ছিলেন আল আমিন নয়ন। সবাই ফিরে পান তাদের কষ্টের টাকা।

আল-আমিন বলেন, ‘বিদেশে কাজে গিয়ে প্রতারণা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরত আসার যে কষ্ট, তা আমার চেয়ে আর কে ভালো বুঝবে! নিজে ভিকটিম তো, তাই অন্যদের কষ্টটা বুঝতে পারি। বিমানবন্দরে ফেরত আসা শ্রমিকেরা যখন নির্যাতনের কাহিনি বলতে থাকেন, আমি তখন আমার নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া দিনগুলো চোখের সামনে দেখতে পাই।

noyon
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরা নারী কর্মীদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন আল আমিন নয়ন।

দিন আর রাত নেই, ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরা নারীরা পাশে পান তাঁদের নয়ন ভাইকে। দেশে ফেরা বেশির ভাগ নারীর সঙ্গে আল-আমিনের মুঠোফোনে আগেই কথা হয়। তাই এই নারীদের কাছে আল-আমিনকে খুব একটা অপরিচিত লাগে না। আর আল-আমিনও আপা, বুবু, খালা—যাঁকে যা ডাকলে মানানসই হয়, সেভাবে ফেরত আসা নারীদের সঙ্গে কথা বলেন।

নির্যাতনের শিকার নারীদের বেশির ভাগই তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া অমানুষিক ঘটনার কথা বিমানবন্দরে নেমে আল-আমিনের কাছে বলেন। নির্যাতনের ধরন অনুযায়ী কার জন্য কী ব্যবস্থা নিতে হবে, তা অফিসের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন আল-আমিন। অনেক সময় তিনি নিজেই ব্যবস্থা নেন। পরে কর্তৃপক্ষকে তা অবহিত করেন।

আল-আমিন জানালেন, দেশে ফেরত আসা নারীদের বাড়ি পাঠানো, সাময়িক আশ্রয় দেওয়াসহ অন্যান্য সহায়তা ব্র্যাকের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়।
কিছুটা আক্ষেপ নিয়ে আল-আমিন বলেন, ফেরত আসা নারী শ্রমিকেরা নাকি মিথ্যা কথা বলেন মর্মে সরকারি প্রতিনিধিরা অভিযোগ করেন। এই নারীরা মিথ্যা বলেন কি না, তা তাঁদের সঙ্গে সরাসরি কথা বললেই বোঝা যেত।

নয়নের সঙ্গে আলোচনায় জানা যায়, প্রায় এক যুগ ধরে প্রবাস ফেরত শ্রমিকদের জন্য কাজ করছেন আল আমিন নয়ন। দীর্ঘ এই সময়ে কয়েক হাজার বিদেশ ফেরত কর্মীকে (নারী-পুরুষ) সহায়তা দিয়েছেন। সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছেন বহু নারীকর্মীকে। জীবনের বাকীটা সময়ও প্রতারণার শিকা বিদেশ ফেরত কর্মীদের পাশে থাকতে চান ‘প্রবাসীবন্ধু’ নয়ন।

সৌজন্যে- প্রবাস সংবাদ