আন্তর্জাতিক বাজারে যখন কোন ওষুধ আসবে বা কোন দামি অ্যান্টিবায়োটিক কোম্পানি বাজারে ছাড়বে, তখন ওরা মার্কেটিংয়ের পিছনে কোমড় বেঁধে নামে। বিভিন্ন জার্নালে রোগের প্যাটার্ন চেঞ্জ করে দেয়, রোগকে আরও ভয়াবহ বানায় ফেলে, এই নিয়ে ইন্টারনেট থেকে শুরু করে পাঠ্যপুস্তকে, জার্নাল পাবলিকেশন তাছাড়া সেমিনার সিম্পোজিয়াম করে, বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা খরচ করে মার্কেটিংয়ের পেছনে।
ফলে যে ওষুধ তৈরিতে খরচ ২০০ টাকা তার দাম হয়ে যায় ১২০০ টাকা। শুধুমাত্র প্রচারের পেছনেই অনেক বেশি খরচ করে তারা, যার রেশ তারা ভোগ করে পরবর্তী নতুন আরেকটা প্রোডাক্ট আনার আগ পর্যন্ত। যদি না অন্য কোন গবেষণায় সেই অ্যান্টিবায়োটিকের কোন কুফল না ধরা পরে। অবশ্য কুফল ধরা পরার চান্স থাকে না, তবে সুফল সবক্ষেত্রে পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ।
কথা বলতে চাই কনভেনশনাল ওয়েতে চিকিৎসা করা নিয়ে। আমি ডাক্তার হবার পর, আমার পক্স হয়, খুব যে বেশি দিন আগে তাও না। ওষুধ বলতে শুধু প্যারাসিটামল ছাড়া আর কিছুই খাইনি। ওষুধ আমি ঠেকে না গেলে খাইও না। কিন্তু তখন কেউই বলেনি, পক্সের কম্পলিকেশন কি কি হতে পারে?
আমাদের আমলের অনেকেই বলতেই পারবে না তার পক্স উঠেছিলো কিনা। যাইহোক কয়দিন আগে আমার ছেলের পক্স হলো। আমি প্রথমে ওষুধের ব্যাপারে পাত্তা দেইনি, ওর জ্বরও ছিল না। ওর বাবা ওভার কনসাস, সে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ায় ছাড়বেই।
আমরা ছেলের ব্যাপারে আলতাফের বন্ধুর (নিবিড় ভাইয়া) চিকিৎসা নেই সাধারণত। আমার কাছে উনার চিকিৎসা রিজোনেবল মনে হয়। কারণ, উনি বেশি ওষুধের কথা কখনও বলেন না। কিন্তু উনিও যখন দুইটা অ্যান্টিবায়োটিক সাজেস্ট করলেন, তখন আর তর্কে না গিয়ে ওষুধ খাওয়ানো শুরু করলাম। কিন্তু আমিও নেট সার্চ, বইপত্র ঘাটাঘাটি করে দেখলাম, উনার চিকিৎসার কারণ বুঝলাম।
কম্পলিকেশনে এমন সব জিনিস আছে যা একেবারে এনক্যাফালাইটিসে ঠেকে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আমি হলেও রিস্ক নিতাম না। আমিও এইসব পড়ে এই ব্যাপারে আর উচ্চবাচ্য করিনি।
কয়েকদিন আগে, প্রিয় এক জুনিয়র বোনের মেয়ের টাইফয়েড তার মেয়েকে সেফট্রায়াক্সন প্রতিদিন, সাতদিন দেয়া হয়েছে খুব অবাক হয়েছি। কেন এমন হচ্ছে। স্যারেরা আমার চেয়েও অনেক ভাল জানেন বোঝেন। তাছাড়া ডিজিস প্যাটার্ন আসলেই চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। ছোটখাটো এন্টিবায়োটিকগুলো আর কাজ করে না, সেই রিস্ক কোন ডাক্তারই নিতে চান না।
আমার ছেলে জন্মের পর, যত রোগবালাই হয়েছে দুইজন বড় প্রফেসরের তত্ত্বাবধানে ছিল। দুই জনই খুব ইথিকেল প্র্যাক্টিস করেন। কোনদিনও অ্যান্টিবায়োটিক দেন নাই কোন অসুখেই না। যতদিন তাদের কাছে দেখিয়েছি, আমার ছেলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক ভাল ছিল। আমি একবার আমার প্রিয় সেই স্যারদের একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “স্যার, আপনি তো এন্টিবায়োটিক দেনই না, কিন্তু এখন তো কথায় কথায় ইঞ্জেকটিভ এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে।”
স্যার একটা কথা বলেছিলেন- “এখনকার বাবা মায়েরা ধৈর্য ধরতে চায় না, চায় ড্রামাটিক রেজাল্ট। যার ফল পরে ভোগ করতে হবে”।
রংপুর থেকে আসার পর কথা কথায় ছেলের বাবা ছেলেকে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়, আমি জানি এর ফল ভোগ করতেই হবে। কিন্তু কী করবো? কী এক ফোবিয়া, মার্কেটিং যারা করে তারা আমাদের মাথায় ঢুকায় দেয়! নিজের বাচ্চা বা কারো বাচ্চার ব্যাপারেই আমরা রিস্ক নিতে পারি না।
কনভেনশনাল ঔষধগুলা বা চিকিৎসা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বিখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ এম আর খান স্যার শুনেছি, এমোক্সিসিলিন, জেন্টামাইসিন দিয়েই চিকিৎসা করে গেছেন। হতে পারে ডিজিস প্যাটার্ন চেঞ্জের কারনে অ্যান্টিবায়োটিকের এমন ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে ডাক্তাররা। ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটিংয়ের প্রভাব যদি ডাক্তারদের ওপর পরে, মানে বলতে চাচ্ছি, এই যে আমি নেট দেখে ভয় পেয়েই আমার ছেলে এন্টিবায়োটিক খাওয়াতে বাধ্য হলাম, তা যদি মার্কেটিংয়ের চাল হয়, তাহলে অ্যান্টিবায়োটিকের অধিক ব্যাবহারেই ডিজিস প্যাটার্ন চেঞ্জ হচ্ছে। কাজেই নতুন কোন প্রোডাক্ট আসলেই দেখা যায়, বইপত্রের নতুন এডিশন চলে আসে। ব্যাপারগুলা সত্যির চিন্তার যার ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
লেখক: ডা. মিথিলা ফেরদৌস, বিসিএস স্বাস্থ্য সাবেক শিক্ষার্থী, রংপুর মেডিকেল কলেজ।
কনটেন্ট ক্রেডিট: মেডিভয়েস