একটা সময় ছিল প্রবাসী মানেই ‘বাঙালি’ নয়, ‘বিদেশি’ হয়ে বেঁচে থাকা। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই বাংলাদেশিদের। ওই ধারণার পুরোটাই পাল্টে গেছে। জর্ডান প্রবাসীরা নিজেকে ষোল আনাই বাঙালিয়ানায় দেখতে না পেলেও বাঙালি জীবনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও সাফল্য এখন অনেক ব্যাপ্তি লাভ করেছে।
পিঠা উৎসব, একুশে ফেব্রুয়ারি পালন, বিজয় ও স্বাধীনতা দিবস উদযাপন, বৈশাখী মেলার জমকালো আয়োজনসহ হরেক রকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অভিবাসীরা জাগিয়ে রাখছে নিজ দেশের শিল্প-সংস্কৃতি এই প্রবাসেও। জর্ডান এখন বাঙালিদের নিয়মিত সাংস্কৃতিক চর্চার প্রাণকেন্দ্র।
একজন প্রবাসী কী নিঃসঙ্গ? প্রবাসীরা সত্যিই নিঃসঙ্গ নয় এমনটি বলা যাবে না। তবে এই নিঃসঙ্গ জীবনেও রয়েছে বৈচিত্রতা। প্রবাস জীবনের এই বৈচিত্রতা কেটে যায় একেক ভঙ্গিমায়, একেক রঙে। সেটা কখনো আনন্দের। কখনো অতি স্বাধীনতায় হারিয়ে ফেলে জীবনের ছন্দ ও সুর। এ নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই খোদ প্রবাসীদের মধ্যেই।
একজন প্রবাসীর মানসিক অস্থিরতা, তার আবেগ, কষ্ট-ভালোবাসা, ও নীরব কান্না এসব কিছুই দেশ ও স্বজনদের নিয়ে। হোকনা তা মা ও মাটির সান্নিধ্য থেকে অনেক দূরে। দেশে বাস করে দেশকে উপেক্ষা করা যায়। কিন্তু প্রবাসে এলে দেশকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়, দেশ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টে যায়।
একজন প্রবাসী শুধু পরবাসী নয়, মননে, চিন্তায়, চেতনায় স্বদেশবাসীও বটে। দেশকে নিয়ে প্রবাসীদের অন্তহীন অন্তর্জালা কতটা যে গভীর ও বেদনাময় তা ভুক্তভোগী প্রবাসীরাই জানে। তবে অদৃশ্য এই অনুভূতির জায়গাটুকু প্রেরিত হাজার কোটি ডলার রেমিট্যান্সের হিসাব দিয়ে অঙ্ক কষলে বের হবে না যে! দূর থেকে দেশকে ভালোলাগা ও ভালোবাসার এই হৃদয়স্পর্শী আবেগটুকু যে কতটা ‘ননস্টপ’ তা কাউকে বোঝানো যাবে কি? যাবে না।
কারণ, প্রবাসীদের ভালো থাকা, মন্দ থাকা অনেকটাই নির্ভর করে দেশের মানুষগুলো সুস্থ ও শান্তিতে থাকার ওপর। প্রবাসীরা তো পরবাসী। তবু মন আর হৃদয়টা যে কখনই ‘পরবাসী’ হতে চায় না। ভালো লাগা, না লাগার পুরো আবেগটাই যেন জড়িয়ে থাকে দেশের জন্য, দেশের স্বজনদের জন্য। প্রবাসী মানে বৃক্ষের শিকড় রেখে উপড়ে ফেলা একগুচ্ছ ডালপালা, যে সর্বক্ষণ শিকড়ের সন্ধানে হাতছানি দিয়ে ডাকে। অন্তত ব্যক্তি প্রবাসী হিসাবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় আমার কাছে তা-ই মনে হয়।
নিঃসঙ্গতা কি? নিঃসঙ্গতা মানে তো কারো অনুপস্থিতি ভীষণভাবে অনুভব করা। কাউকে গভীরভাবে মিস করা। আর একাকিত্ব? একাকিত্ব হলো ওই নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে নিজের মাঝে নিজেকে সতেজ রাখা। ভালো রাখতে সচেষ্ট থাকা। শত কষ্টেও অন্যত্র নিজেকে ‘খাপ’ খাইয়ে নেয়া। নিঃসঙ্গতা যদি হয় কাউকে মিস করা, নিঃসঙ্গতা যদি হয় প্রিয়জনদের অনুপস্থিতি গভীরভাবে অনুভব করা, তাহলে তো প্রবাসীরা নিঃসঙ্গই বটে।
এত নিঃসঙ্গতার মাঝেও প্রভাতে দোয়েল পাখির শীষে প্রবাসীদের ঘুম ভাঙ্গে। ঘু ঘু পাখিগুলোর রমরমা ডাকা-ডাকি মনকে উতলা করে। কী এক অদ্ভূত নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলেও ওই দৃশ্যমান পাখিগুলোকে কেন এত অচেনা মনে হয়? আচ্ছা, সীমান্ত পেরিয়ে গেলেও কী ওই ঘন নীল আকাশের রঙ কখনো ভিন্ন হয়? হয় না। তবু কেন মনে হয় ওই চিরচেনা আকাশটা এত অচেনা? এই সবই তো নিঃসঙ্গতা।
এই নিঃসঙ্গ প্রবাসীরাই একাকিত্ব জীবন নিয়ে দেশ আর স্বজনদের মাঝেই নিজেকে লুকিয়ে রাখে। প্রবাসীরা দেশ ও স্বজনদের নিয়েই স্বপ্ন দেখে। কখনো আড়ালে। কখনো প্রকাশ্যে। ওই স্বপ্নগুলো কেবলই সাদাকালো নয়। রঙ-বেরঙেরও হয়।
অনেকেরই ধারণা প্রবাসে থাকা মানে না ‘বিদেশি’ না ‘বাঙালি’ হয়ে বেঁচে থাকা। প্রবাস মানে কী একঘেয়েমি জীবন? প্রবাসী মানে কী সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ভুলে যাওয়া? নাকি এই একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গ জীবনেও প্রবাসীরা আকড়ে ধরে থাকে দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি?
উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পাল্টে দিয়েছে ‘না বাঙালি’ হয়ে বেঁচে থাকার ওই সংকুচিত ধারণাটি। এই তো, এখন থেকে দেড় যুগ আগেও কোনো বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল জর্ডান কিনবা আমেরিকার ভূখণ্ডে বসে দেখার কল্পনা ছিল কাল্পনিক বিলাসিতা।
আর এখান? শুধু জর্ডান তথা জর্ডান বসেই প্রবাসীরা দেখছে অর্ধ ডজনেরও বেশি বাংলা টিভি চ্যানেল। যেগুলো প্রতিনিয়ত চব্বিশ ঘণ্টাই প্রবাসীদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে বাঙালিয়ানার স্বাদ। শুধু ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াই নয় পুরো জর্ডানজুড়ে অর্ধশতেরও বেশি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে বাংলা ভাষায়। আরো রয়েছে একটি কমিউনিটি প্রবাসী কল্যাণ সমিতি বাংলাদেশি।
একটা সময় যা ছিল কল্পনিক বিলাসিতা তা এখন হয়ে উঠেছে নিত্যদিনের সঙ্গী। জর্ডান এখন বেশকিছু প্রতিনিধিত্বশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনও গড়ে উঠেছে। ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র’ জর্ডান শাখা তাদের একটি। ‘বাংলাদেশি নামের একটি সাংস্কৃতিক চক্রও গড়ে উঠেছে মননশীল সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে।
উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, সত্যসেন স্কুল অব পারফর্মিং আর্টসসহ আরও অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন সংগীত ও নৃত্যের পাশাপাশি বিশেষ বিশেষ সাংস্কৃতিক কর্মসূচি নিয়ে প্রবাসীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এসব কিছুই ‘না বাঙালি’ হয়ে বেঁচে থাকার দৃঢ় অনুপ্রেরণা।
সৌজন্যে- জাগো নিউজ