সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের আকাশচুম্বী এফআর টাওয়ারের বিভিন্ন ফ্লোরে তখনও জ্বলছে আগুন। ২২ তলা ভবনের ওপর থেকে বাঁচার জন্য আকুতি জানাচ্ছে আটকে পড়া হতভাগ্য এক যুবক।
চোখের সামনে সহকর্মীকে বাঁচার জন্য লাফিয়ে পড়তে দেখেও উদ্ধারের আশায় লাফ দেননি তিনি। ওই যুবকসহ অন্যান্যদের উদ্ধার করতে এগিয়ে আসা ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ওই যুবক জিজ্ঞাসা করছিল- আটকা পড়া সবাই উদ্ধার হবে তো? ফায়ার সার্ভিস কর্মী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে অপেক্ষা করতে বলল।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ২২টি ইউনিট দুপুর ১টা থেকে আগুন নেভানোর জন্য অনবরত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
আজ দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে বনানীর এফআর টাওয়ারের ৯ তলা থেকে সূত্রপাত হওয়া এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৭০জন।
রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছেন অর্ধশতাধিক রোগী। তাদের কেউ কেউ প্রাণ বাঁচাতে বহুতল ভবন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আহত হন। আবার কেউ কেউ ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের তৎপরতায় প্রাণে রক্ষা পেলেও ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেকে আগুনে পুড়ে দগ্ধ হয়েছেন।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা কেমিক্যালের গোডাউনের অগ্নিকাণ্ড ৭১ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার মাত্র ৩৮ দিনের মাথায় বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় আকাশছোঁয়া ভবনে আবারও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। এতে করে নতুন ও পুরাতন ঢাকার কোনো এলাকাই নিরাপদ নয় বলে মনে করছে সাধারণ মানুষ।
চকবাজারের চুড়িহাট্টা কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর বলা হয়েছিল- পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকায় অপরিকল্পিত ঘরবাড়ি থাকায় এবং কেমিক্যালের কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কিন্তু বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর আটকে পড়া মানুষের আহাজারি বেঁচে থাকার জন্য করুণ আর্তি বহুতল ভবন থেকে লাফিয়ে পড়া, ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মরার উপক্রম ইত্যাদি চিত্র গণমাধ্যমে দেখে নগরবাসীর অনেকেই আঁতকে উঠেছেন। তাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে- চকবাজারের চুড়িহাট্টা ও বনানীর এফআর টাওয়ারের পর কোন ভবনে আগুন লাগবে? কতজন মারা যাবে, কতজন আহত হবে- কে জানে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম আজ সন্ধ্যায় অগ্নিকাণ্ড স্থল পরিদর্শন করে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ২২ তলা ভবনের সিঁড়ির প্রশস্ততা মাত্র তিন ফুট। এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স কর্মীরা বলছেন, বনানীর মতো অভিজাত এলাকাতেও ভবনগুলো যথাযথ নির্মাণ নীতিমালা মেনে করা হয়নি। আকাশচুম্বী ভবনগুলো একটি আরেকটার গা ঘেঁষে আছে।
গত দশ বছরে রাজধানীসহ সারাদেশে ১৬ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে যাতে ১ হাজার ৫৯০ জন প্রাণ হারিয়েছেন বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এসব তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। সে ঘটনায় একই পরিবারের ১১ জন ব্যক্তি প্রাণ হারান। নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারি পর্যায়ে গঠিত সকল তদন্ত কমিটি এলাকার রাসায়নিক মজুদ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং পুরান ঢাকার সকল আবাসিক ভবন থেকে রাসায়নিক দোকান, কারখানা, গুদাম উচ্ছেদের সুপারিশ করে।’
তিনি বলেন, ‘গত ২০ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে আরও ৭১ জনের প্রাণহানি হয়। বিভিন্ন মহল থেকে দোষী ব্যক্তির শাস্তির আশ্বাস মিললেও শাস্তি দৃশ্যমান হয়নি এখনও।’
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে অগ্নিঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ পুরান ঢাকা শীর্ষক গণশুনানিতে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এসব কথা বলেন।
এদিকে ফায়ার সার্ভিসের একটি সূত্রে জানা গেছে রাজধানী ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। বড় বড় ঘটনা মিডিয়াতে এলেও অনেক ঘটনা লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে যায়বলে তারা মন্তব্য করেন।
লেখক- মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল, সৌজন্যে- জাগো নিউজ