বেতন দ্বিগুণ করা হলেও সরকারি দপ্তরগুলোতে দুর্নীতি কমেনি। বেতন বাড়ানোর পরও দেখা গেছে গত তিন বছরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ আরো বেড়েছে। কাস্টমস, ভূমি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ওয়াসা এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরতদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়তই দুদকে আসছে বিস্তর অভিযোগ। দুদক বলছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি ঠেকাতে দপ্তরগুলোতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে দুর্নীতি কমবে না বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা।
সরকারি চাকরিজীবীদের জীবনমান উন্নয়ন ও দুর্নীতি কমাতে ২০১৫ সালে বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করে সরকার। ২০১৬ সালের ১ জুলাই যা কার্যকর হয়। বেতন-ভাতা বাড়িয়ে সরকারের তরফে বল হলো, নতুন কাঠামোতে বেতন দ্বিগুণ হওয়ায় সরকারি কর্মচারীদের জীবনমান বাড়বে, ফলে দুর্নীতি কমবে। কিন্তু বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বলছে, দুর্নীতি কমেনি।
আয়বহির্ভূত ৪৮ লাখ ৬৭ হাজার টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. মোহাম্মদ আমিনকে গ্রেপ্তার করে দুদক। বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে নিজ কার্যালয়ে ঘুষের টাকাসহ দুদকের জালে ধরা পড়েন নৌপরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম ফখরুল ইসলাম। নৌযানের নকশা অনুমোদনের জন্য ঘুষ লেনদেনে অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। এর ৬ মাসের মাথায় ঘুষের ৫ লাখ টাকাসহ একই অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী নাজমুল হোসেন রাজধানীর সেগুনবাগিচায় সেগুন রেস্টুরেন্ট থেকে দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হন।
একইভাবে আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সিভিল এভিয়েশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আসির উদ্দিনকে ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করে দুদক। দুর্নীতির অভিযোগে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাবেক প্রধান প্রকৌশলী এনামুল ইসলামকে দুদক গ্রেপ্তার করে ২০১৭ সালের ২ মার্চ। পরিদর্শনের পর একটি বিদ্যালয়ের পক্ষে প্রতিবেদন দেয়ার শর্ত হিসেবে ‘ঘুষ হিসেবে নেয়া’ দুই লাখ টাকাসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমানকে ২০১৭ সালের ৩০ মে গ্রেপ্তার করে দুদক। সর্বশেষ চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি ঘুষের টাকাসহ দুদকের হাতে ধরা পড়েন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন আহমেদ। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করে দুদক।
এভাবে ঘুষ ও বিভিন্ন দুর্নীতির দায়ে গত তিন বছরে দুদকের হাতে আটক হয়েছেন ৬৩৭ জন। যাদের বেশির ভাগই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪ সালে দুদকে লিখিত অভিযোগ জমা হয় ১২ হাজার ৫০০টি, ২০১৫ সালে ১০ হাজার ৪১৫, ২০১৬ সালে ১৩ হাজার, ২০১৭ সালে ১৭ হাজার ৯৮৩, ২০১৮ সালে ১৭ হাজার অভিযোগ জমা হয়। এসব লিখিত অভিযোগের প্রায় অর্ধেকই সরকারি অভিযোগ সংক্রান্ত।
এ ছাড়া ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই দুদকের হটলাইন চালু হওয়ার পর, এ পর্যন্ত ফোনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে লক্ষাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। দুদকে আগে জমা পড়া কয়েক বছরের অভিযোগ বিশ্লেষণ করেও দেখা যাচ্ছে সূচকটি ঊর্ধ্বমুখী। বেড়েছে দুদকের গ্রেপ্তার ও ফাঁদ মামলার সংখ্যাও। দুদকের নথিপত্র বলছে, সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে ভূমি প্রশাসন, আর্থিক খাত, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পাসপোর্ট অফিসে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়। দুদকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূলত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ বেশি আসছে, অন্য পেশার মানুষের প্রতি অভিযোগ খুবই কম।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দীন খান বলেন, শুধু বেতন বৃদ্ধিতে দুর্নীতি কমবে না। চাকরিতে দলীয়করণ থাকলে দুর্নীতি বাড়ে। দুর্নীতি রোধে সরকারি প্রচেষ্টাও একটা বড় বিষয়। আদালতের রায়ে গলদ ও দীর্ঘসূত্রতা থাকলে দুর্নীতি হয়।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বেতন যদি জীবনধারণ ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তাহলে দুর্নীতি কমে আসা উচিত বলে ধরা হয়। এটা প্রয়োজনীয়, কিন্তু যথেষ্ট নয়। যারা দুর্নীতি করেন, তারা শুধু বেতন-ভাতা কম পেলেই দুর্নীতি করেন, বিষয়টি এমন নয়। অনৈতিকতা, আইনের লঙ্ঘন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদ বৃদ্ধির উপায় হিসেবেও তারা দুর্নীতি করেন। বেতন-ভাতা বাড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা দুর্নীতি করছেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দিতে হবে। এ বিষয়গুলো পাশাপাশি হয়নি বলেই বেতন বৃদ্ধি সত্ত্বেও ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পাই না।