আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ১৪টি প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইশতেহার প্রকাশ করেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সোমবার সকালে রাজধানীর পূর্বাণী হোটেলে ৩৫ দফা ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। ইশতেহার পাঠ করেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না।
ঐক্যফ্রন্টের এই ইশতেহারে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য ও পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে না থাকার প্রতিশ্রুতি ছাড়াও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা, প্রশাসনিক সংস্কার ও বিকেন্দ্রীকরণ, মৌলিক অধিকার রক্ষায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল, পিএসসি এবং জেএসসি পরীক্ষা বাতিল, চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা বাড়ানো, নারীর নিরাপত্তা এবং ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। প্রতিহিংসার রাজনীতি দূরীকরণ, নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, দুর্নীতি দমন ও সুশাসনসহ ১৪টি বিষয়ে আমূল পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। নির্বাচিত হতে পারলে পাঁচ বছরের শাসনকালে যেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা যাবে, সেগুলোর ওপর জোর দিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট।
ইশতেহারে উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে রয়েছে- ব্যাংকিং সেক্টরে লুটপাটে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, দুর্নীতি দমন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হবে, এই সরকারের আমলের দুর্নীতি তদন্ত করে তার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা হবে, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা হবে, রিমান্ডের নামে পুলিশি হেফাজতে যেকোনো শারীরিক নির্যাতন বন্ধ করা হবে, সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না, মিথ্যা মামলায় অভিযুক্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে এবং মিথ্যা মামলায় সহায়তকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে, কর্মক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতের সকল ক্ষেত্রে নারীর ওপর বাচিক কিংবা শারীরিক যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখানো হবে, নির্বাচন কমিশনকে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দেওয়াসহ অন্যান্য পদক্ষেপ দেওয়ার মাধ্যমে মুক্তভাবে মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার নিশ্চিত করা হবে, সংসদে উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা হবে, সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনা হবে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ঘোষিত ইশতেহারে ‘কর্মসংস্থান ও শিক্ষা’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে পুলিশ ও সামরিকবাহিনী ছাড়া সরকারী চাকরিতে প্রবেশের জন্যে কোনো বয়স সীমা থাকবে না। এতে বলা হয়, সরকারী চাকরিতে শুধুমাত্র অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধীদের জন্যে কোটা ছাড়া আর কোনো কোটা থাকবে না।
৩০ বছরের ওপরে শিক্ষিত বেকারের জন্যে বেকার ভাতা চালু করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা পরীক্ষা করে বাস্তবায়ন করার জন্যে একটি কমিশন গঠন করা হবে।
দেশে কাজ করা ওয়ার্ক পারমিটবিহীন অবৈধ সব বিদেশী নাগরিকের চাকরি করা বন্ধ করা হবে। শিক্ষিত বয়োবৃদ্ধদের জন্যে ন্যূনতম ভাতা রেখে অবৈতনিক খণ্ডকালীন কর্মসংস্থান করা হবে।
গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি হবে ১২ হাজার টাকা। প্রথম বছরে গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে না। প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা হবে।
‘সকল নাগরিকের কল্যাণে সরকার পরিচালনা করবে ঐক্যফ্রন্ট’
ইশতেহার পাঠের সময় মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, নির্বাচনে জিতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের কল্যাণে সরকার পরিচালনা করবে। এই পরিচালনার মূলনীতি হবে ঐক্যমত্য, সকলের অন্তর্ভূক্তি এবং যে কোনো রকম প্রতিহিংসা থেকে মুক্ত থাকা। ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বর্ণিত এই নীতির ভিত্তিতে সরকার পরিচালনায় যাবতীয় পদক্ষেপের ভিত্তি হবে রাষ্ট্রের মালিকগণের মালিকানা সুদৃঢ় করা। রাষ্ট্রের এই মালিকানা শুধুমাত্র নির্বাচনে জেতা দলের মানুষের নয়, এই মালিকানা থাকবে নির্বাচনে পরাজিত দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদেরও। এই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে নির্বাচনে পরাজিতদের মতামত এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। এই রাষ্ট্র নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা আছে, নির্বাচনে জিতলে পরবর্তিতে সেটা আমরা জনগণের সামনে নিয়ে আসব। এই অঙ্গীকারে আমরা শুধু সেই বিষয়গুলোকে স্থান দিয়েছি যেগুলো আগামী ৫ বছরের মধ্যে আমরা সম্পন্ন করব।
রাষ্ট্রের মেরামত প্রয়োজন: ড. কামাল
ইশতেহার ঘোষণার আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পর, বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু এই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের নানা রকম পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ আমাদের শঙ্কিত করছে।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এই শীর্ষনেতা বলেন, ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি, নির্বাচনের নামে যে প্রহসনটি হয়েছিল সেটা সংবিধানে বর্ণিত জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের বাধ্যবাধকতার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। এই নির্বাচনের মাধ্যমেই এই জনগণ এই রাষ্ট্রের মালিকানা হারিয়েছে। জনগণ যখন রাষ্ট্রের মালিক থাকে না, তখন রাষ্ট্রের মালিক হয়ে পড়ে কায়েমী স্বার্থবাদী দেশি-বিদেশি নানা গোষ্ঠী। এর মাশুল দিতে হয়েছে এ দেশের মানুষকে। এই রাষ্ট্রটি মানুষের জন্য একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবে কি না, সেটা নিশ্চিত হবে আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে। যদি এই রাষ্ট্র জনগণের হাতে আবারও ফেরত যায়। জনগণ তার মালিকানা ফেরত পায়। জনগণের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ তখনই নিশ্চিত হতে পারে, যখন সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ।’
ড. কামাল আরো বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের মতো আমরাও বলতে চাই, এই রাষ্ট্রের মেরামত প্রয়োজন। আগামী সাধারণ নির্বাচনের দিন, ৩০ ডিসেম্বর। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বিশ্বাস করে, সেদিন দলে দলে জনে জনে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাবে, ভোট দেবে, ভোটকেন্দ্রে অবস্থান করে ভোটের অনিয়ম রুখবে, ভোট শেষ হওয়ার পর নিজেদের ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়া দেখে বাড়ি ফিরবে। নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে এক গণঅভ্যুত্থানের দিন হবে ৩০ ডিসেম্বর।’
নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহারের বিষয়ে কামাল বলেন, ‘আজকের এই দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে, আজ আমরা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করছি। এটা জনগণের ইশতেহার। জনগণের কল্যাণে, জনমতের ভিত্তিতে, এটা তৈরি করা হয়েছে এবং সাধারণ মানুষের মতামত গ্রহণের ধারা অব্যাহত থাকবে।’
কামাল আরো বলেন, ‘বাংলাদেশকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে জনগণের মতামতকেই সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দেওয়ার প্রচেষ্টা থাকবে। বাংলাদেশ হবে, গুম, খুন, হত্যা, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত শান্তি-সুখের বাংলাদেশ।’
ড. কামাল বলেন, ‘আমরা এখনো আশাবাদী। আশা করছি, পরিশেষে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নির্বাচন বাংলার জনগণ নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। পুনরুদ্ধার হবে নিবিড় গণতন্ত্র।’
ইশতেহার ঘোষণা অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর আবদুল কাদির সিদ্দিকী, গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, গণফোরামের কার্যকরী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, গণফোরামের নেতা রেজা কিবরিয়া, জগলুল হায়দার আফ্রিক, জেএসডির শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন। এছাড়াও উপস্থিত আছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপচার্য এমাজ উদ্দিন আহম্মেদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সুকল বড়ুয়া, সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, ডা. এজেড এম জাহিদ হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রমুখ।#