৬৮ বছর বয়সী সিরাজুল ইসলাম ছিলেন বিমান বাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার। সংসারে স্ত্রী ও চার মেয়ে থাকলেও কোনো ছেলে সন্তান ছিল না। স্ত্রী কৌশলে পৈত্রিক ভিটা বাড়ি বিক্রি করে দেন। তারপরও সুখেই কাটছিল তার চাকরি জীবন। কিন্তু অবসরে যাওয়ার কয়েক বছর পরই দেখা দেয় অশান্তি। এক সময় স্ত্রী-সন্তানদের রোষাণলে পড়তে হয় তাকে।
শেষমেষ সিরাজুল ইসলামের ভুয়া মৃত্যু সনদ বানিয়ে ব্যাংকে গচ্ছিত জীবনের সবটুকু আয় তুলে নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয় তাকে। একইসঙ্গে নিজের মাসিক পেনশনের টাকা উত্তোলনের ক্ষমতাও নিয়ে নেন স্ত্রী। জীবিত হয়েও মৃত্যু সনদ বাতিল করতে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন সিরাজুল ইসলাম। কিন্তু কোনো প্রতিকার না পেয়ে আজ তার ঠাঁই হয়েছে গাজীপুরের জয়দেবপুর থানাধীন মনিপুর বিশিয়া কুড়িবাড়ি ‘বয়স্ক পূনর্বাসন কেন্দ্রে’। বৃদ্ধাশ্রমে বসে এখন শুধু ডুকরে ডুকরে কাঁদেন আর সেই সোনালী অতীতের কথা ভাবেন।
শনিবার বৃদ্ধাশ্রম নিবাসীদের খোঁজ নিতে গেলে সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় হয়। এ সময় তিনি তার জীবনের নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেন। তার বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার রাজেন্দ্রপুর এলাকায় হলেও চাকরি সুবাদে বসবাস করতেন ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকার পাশে এক ভাড়া বাড়িতে। সেখানেই স্ত্রী ও মেয়েদের নিয়ে থাকতেন।
স্ত্রীর পরামর্শে নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে গাজীপুর জেলার রাজেন্দ্রপুরের আতলরা এলাকায় শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি কেনেন স্ত্রীর ও মেয়েদের নামে। এতে তার নিজের ভাই-বোনদের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি হয়।
২০০২-০৩ সালে অবসরে যাওয়ার পর বাড়ি ভাড়া ও সংসার খরচ চালানোর মতো অবস্থা ছিল না। পরে চাকরি নেন ঢাকার বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক অফিসে।
তিনি বলেন, সেখানে ইনফরমেশন কাউন্টারে কাজ করতেন। ২০০৪ সালে সেখানে নার্স নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিলে এক নারী আবেদনকারী আমার ব্যাগে তার আবেদন ও ছবি রেখে যান। ভুলে তা আমার বাসায় চলে যায়। পরে ব্যাগ খুলে আমার স্ত্রী ওই আবেদনকারীর ছবি দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এনিয়ে স্ত্রীর সন্দেহ হয় এবং সংসারে কলহ সৃষ্টি হয়।
এক পর্যায়ে আমার স্ত্রী ঠিকানা অনুসারে ওই নারীর বাসায় গিয়ে তাকে গালাগালি করে আসে। বাড়িতে ফিরে আমাকে দা দিয়ে কোপাতে তেড়ে যায়। বাইরে কোনো কাজে দেরি হলেই আমাকে সন্দেহ ও আমার সাথে ঝগড়া শুরু করে। অশান্তির এক পর্যায়ে সেখান থেকে গ্রামের বাড়ি ছোট ভাই সফিউদ্দিনের কাছে চলে যাই। পৈত্রিক জমি বিক্রি করে শ্বশুরদের জমি কিনে স্ত্রী-সন্তানের নামে দেয়ায় ভাইয়েরাও আমাকে ভালোভাবে নেয়নি। কিছুদিন যাওয়ার পর ছোটভাইও আমার নামে থাকা অবশিষ্ট ১০ কাঠা জমি লিখে নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়।
পরে বেশ কয়েকমাস পরে (২০০৬ সালে) আবার ঢাকার বাসায় ফিরে গেলে স্ত্রী আমাকে স্বামী বলে অস্বীকার করেন এবং তার স্বামী মারা গেছেন বলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। পরে সেখান থেকে গাজীপুরের কোনাবাড়ির এক আত্মীয়ের বাসায় উঠি। সেখানে থাকা অবস্থায় আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। তারা পরে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয় এবং সুস্থ হলে আমাকে গাজীপুরের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়।
পরে ব্যাংকে আমার টাকা তুলতে গিয়ে জানতে পারি নমিনি থাকা আমার স্ত্রী ও ছোট মেয়ে আমার নামে ডেথ সার্টিফিকেট জমা দিয়ে ব্যাংকে জমানো জমি-বিক্রির ১০ লাখ ও পেনশনের ১২ লাখ টাকা তুলে নিয়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে ব্যাংক ও বিমান বাহিনীর অফিসে গেলে ঘটনাটি আদালতের মাধ্যমে প্রমাণ করতে পরামর্শ দেয়া হয়। এখন শেষ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে থেকে আইনি লড়াই করার শক্তি আমার নেই।
তারই মতো বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন কুমিল্লার জাহানারা বেগম (৭৫)। অতীতের স্মৃতিচারণ করে বলেন, তার স্বামীও বিমান বাহিনীতে চাকরি করতেন। ৪০ বছর আগে তার স্বামী চার ছেলে ও পাঁচ মেয়ে রেখে মারা গেছেন। সকলের বিয়ে হওয়ার পর যে যার মতো আলাদা হয়ে গেছে। একসময় আমার ছোট ছেলে আমাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। সেখানেই চলছিল আমার জীবনযাপন। একদিন আমার ছোট ছেলে ও তার স্ত্রী প্রয়োজনের কথা বলে পাঁচ লাখ টাকার চেক স্বাক্ষর করে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়। বেশ কিছুদিন পর তারা আবারও আট লাখ টাকা চেক দিতে বলে। কিন্তু তাতে রাজী না হওয়ায় তাকে বকাঝকা শুরু করে এবং বাড়ি থেকে বের করে দেয়।
এদিকে অন্যদের না দিয়ে শুধু ছোট ছেলেকে টাকা দেয়ায় অন্য সন্তানদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত আমি চলে আসি গাজীপুরের এই বৃদ্ধাশ্রমে। এখানে চার বছর ধরে আছি। সন্তানেরা আমাকে ভুলে থাকলেও আমিতো তাদের ভুলতে পারি না।
একদিন যেই সন্তানদের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছি, দেহের রক্ত পানি করে বড় করেছি কিন্তু তারা কেন পাল্টে যায়? শুধু আইন করে সন্তান ও বাবা-মায়ের সম্পর্ক টিকে থাকে না। আমি মনে করি সন্তানদের মানবিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা খুব প্রয়োজন।
গাজীপুরের জয়দেবপুর থানার মনিপুর বিশিয়া কুড়িবাড়ি এলাকায় অসহায় মানুষের কল্যাণে এক মানবপ্রেমী শিল্পপতির গড়ে তোলা বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে এভাবেই আছেন সামাজিকভাবে নিগৃহীত, দরিদ্র কবলিত ও পারিবারিক নির্যাতনের শিকার অসহায় প্রবীন মানুষগুলো। শেষ বয়সে যখন ছেলে-মেয়ে ও নাতি নাতনীদের ভালোবাসা পাওয়ার কথা সেখানে মানুষের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে তাদের স্থান হয়েছে ভিন্ন এক পরিবেশে।
কর্তৃপক্ষের আদর যত্নের কোনো ঘাটতি না থাকলেও মনের ভেতর লুকায়িত ভালোবাসার অভাবটা বার বার উঁকি দেয় তাদের মনে। তবে তাদের কোনো অভিশাপ নেই পরম মমতায় লালন করা সন্তানদের প্রতি। নিয়তিকেই মেনে নিয়ে শেষ দিনের অপেক্ষায় রয়েছেন এই প্রবীন মানুষগুলো।
গাজীপুর সদর উপজেলার বিকে বাড়ি বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা খতিব মো. জাহিদ হোসেন মুকুল জানান, বর্তমানে গাজীপুরের বয়স্ক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে ২০৬ জন নিবাসী রয়েছেন। তাদের মধ্যে ১০৬ জন পুরুষ এবং ১০০ জন নারী।
কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক মো. আবু শরিফ জানান, এখানে যারা আছেন তাদের জন্য কোন খরচ দিতে হয়না। নিবাসীদের বিনামূল্যে কাপড় ও চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়, যার যার ধর্ম পালনের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানকার নিবাসীদের বিনোদনের জন্য খেলাধুলা ও টেলিভিশন এবং পত্রিকা ও বই পড়ারও ব্যবস্থা রয়েছে। তবে যারা এখানে আসতে চান তাদের চলাফেরায় সক্ষম ও বয়স ৬০ বছর বা বেশি হতে হবে। মৃত্যুর পর এখানেই তাদের দাফন ও সৎকারের ব্যবস্থা করা হয়।