শুধু জল্পনা-কল্পনায় কর্ণফুলী টানেল নয় এবার বাস্তবায়নের পথেও। অর্থনৈতিক, কারিগরি ও ভূমি অধিগ্রহণের মতো সমস্যা পেরিয়ে আগামী অক্টোবরেই শুরু হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল বোরিংয়ের কাজ। স্বপ্নের টানেল নির্মাণে চীন থেকে আনা হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম)
কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে এই টানেল হবে চার লেনের। মূল টানেল হবে দুটি টিউবসহ ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার। টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক হবে। সঙ্গে হবে ৭২৭ মিটার ওভারব্রিজও। পাঁচ বছর পর এই প্রকল্পের কাজ শেষে টানেল চালু হলে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে নদীর অপর পারের আনোয়ারা উপজেলার সরাসরি সংযোগ স্থাপন হবে। গড়ে উঠবে সাংহাইয়ের মডেলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন।’
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর উভয় তীরে পরিকল্পিত উন্নয়ন, নগরায়ণ, সমুদ্রবন্দর সুবিধার সম্প্রসারণ, দক্ষিণ চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন, ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, আধুনিক পর্যটনের বিকাশ এবং বৈপ্লবিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, পরবর্তী পর্যায়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মিয়ানমার হয়ে চীনের কুনমিং প্রদেশ পর্যন্ত সরাসরি মহাসড়কে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যেই এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সরকার।
নির্মিতব্য কর্ণফুলী টানেল দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করবে। চালুর তিন বছর পর ওই সংখ্যা দাঁড়াবে ৭৬ লাখে। চালুর প্রথম বছরে চলাচলকারী গাড়ির প্রায় ৫১ শতাংশ কন্টেইনারবাহী ট্রেইলর ও বিভিন্ন ধরনের ট্রাক ও ভ্যান। বাকি ৪৯ শতাংশের মধ্যে ১৩ লাখ বাস ও মিনিবাস আর মাইক্রোবাস। বাকি ১২ লাখ কার, জিপ ও বিভিন্ন ছোটগাড়ি।
অর্থছাড়সহ বিভিন্ন কারণে দুই দফা পিছিয়ে যাওয়ার পর টানেল নির্মাণের পথে সর্বশেষ বাধা ছিলো টানেল খননের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া টানেল বোরিংয়ের জন্য চীন থেকে টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) আসতে দেরি।
তবে আশার কথা হলো- গত জুলাইয়ের শেষ দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের এসে পৌঁছায় কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পে নদীর তলদেশে খননের মূল যন্ত্র ‘টানেল বোরিং মেশিন’ (টিবিএম)। ইতোমধ্যে মেশিনটি প্রকল্প এলাকায় এসে পৌঁছেছে। বর্তমানে চলছে মেশিনটি চালুর প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম। তবে চীন থেকে আলাদা আলাদা ভাগে আনা বিশাল এই যন্ত্রটি জোড়া লাগিয়ে কাজ শুরু করতে আরও অন্তত দুই মাস সময়ের প্রয়োজন হবে।
কর্ণফুলী টানেলের প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ বলেন, ‘টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) একটি চারতলা ভবনের সমান যন্ত্রাংশের সমন্নয়। এই মেশিনকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে দেশে এনে পরে সংযোজন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে নদীগর্ভে টিবিএম নামানোর জন্য টানেলমুখের দুই প্রান্তে জেটি নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। টিবিএম স্থাপনের জন্য উপযোগী প্লাটফর্ম ও যাবতীয় কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। শেষ হয়েছে সেগমেন্ট তৈরি কাজ। এখন ওয়ার্কশপ, প্ল্যান্টারের কাজ হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কর্ণফুলী টানেলটি হবে ‘ডুয়েল টু লেন’ টাইপের। ‘শিল্ড ড্রাইভেন মেথড’ পদ্ধতিতে এই টানেল নির্মাণ করা হবে। টিবিএম মেশিনটি প্রকল্পে পশ্চিম প্রান্তের সুড়ঙ্গে প্রবেশ করা হবে। সেখান থেকে মেশিনটির মাধ্যমে সুড়ঙ্গের কাজ করতে করতে আনোয়ারা অংশ পর্যন্ত যাওয়া হবে।’
শনিবার (২৫ আগস্ট) কর্ণফুলী টানেলের প্রকল্প পরিদর্শনে এসে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বোরিং মেশিন আসার মধ্য দিয়ে এই প্রকল্পের কাজে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে টানেলের বোরিং মেশিন কাজ শুরু করবে। কাজ শুরুর আগে প্রস্তুতি চলছে। বোরিং মেশিন যখন এসে গেছে, টানেলের ভবিষ্যত নিয়ে সন্দেহ থাকার কোনো কারণ নেই। ২৪ শতাংশ সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে টানেলের।’
চীন তাদের দেশের বাইরে প্রথমবারের মতো টানেল খননে নিজেদের তৈরি টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) ব্যবহার করতে যাচ্ছে। চীনা কোম্পানি ‘টানহেং মেকানিক্যাল’ দেশটির জিয়াংসু প্রদেশের কারখানায় টানেল বোরিং মেশিনটি (টিবিএম) প্রস্তুত করেছে। যা চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত হবে।
উৎপাদকারী সংস্থা টানহেং মেকানিক্যাল ও চীনের গণমাধ্যমের দাবি, ১২ দশমিক ১২ মিটার ব্যাসের মেশিনটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ব্যবহৃত সবচেয়ে বড় বোরিং মেশিন। বাংলাদেশের জন্য চীনের তৈরি এই টিবিএমটির দৈর্ঘ্য ৯৪ মিটার এবং এটির ওজন ২২ হাজার টনের বেশি।
সূত্র জানায়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে টানেল খননে যেসব ‘টানেল বোরিং মেশিন’ (টিবিএম) ব্যবহৃত হয় তার অধিকাংশই তৈরি করে পশ্চিমা দেশগুলো। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের টিবিএম প্রস্তুত করার মধ্য দিয়ে টিবিএম নির্মাণ ও সরবরাহে পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর এই একচেটিয়া বাজারে ভাগ বসাতে যাচ্ছে চীন। প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের টিবিএম প্রস্তুত করেছে চীনা কোম্পানি ‘টানহেং মেকানিক্যাল।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চীনের সাংহাই বন্দর থেকে জাহাজে করে গত জুলাই মাসের শেষদিকে টিবিএম মেশিনটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। এর আগে গত মার্চে চীনের জিয়াংসু প্রদেশের চাংশু শহরে এই টিবিএম মেশিনটির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। ট্রায়াল অ্যাসেম্বলি ও ফ্যাক্টরি অ্যাকসেপট্যান্স টেস্টিংয়ে উত্তীর্ণ হয়েই বাংলাদেশে পাঠানো হয় মেশিনটিকে। বাংলাদেশে এটির ফাইনাল অ্যাসেম্বলি করতে আরও প্রায় ২ মাস সময় লাগবে। বিশাল এই যন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিদিন ছয় থেকে সর্বোচ্চ আট মিটার পর্যন্ত নদীর তলদেশে বোরিং করা যাবে।
শনিবার (২৪ আগস্ট) সরেজমিনে দেখা যায়, ইতোমধ্যে টানেল খনন কাজ শুরুর জন্য প্রাথমিক সব অবকাঠামো তৈরির কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) বসানোর প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে নদীর তলদেশে খননের জন্য ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ২৫ মিটার গভীরতা সম্পন্ন ওয়ার্কিং শেফটের অবকাঠামোর কাজও প্রায় শেষ।
প্রকল্পে পতেঙ্গা সাইটে একটি ৩৩ কেভি ও দুটি ১১ কেভি ক্ষমতার লাইন স্থাপন করা হয়েছে। এরই মধ্যে এই লাইন দু’টিতে দুই মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া গেছে। আনোয়ারা প্রান্তে দুই মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ শেষ পর্যায়ে। পতেঙ্গা ও আনোয়ারা উভয় পারে নির্মাণ করা হয়েছে দুটি জেটি।
টানেল প্রকল্পের স্থানীয় ঠিকাদার আনোয়ার হোসেন জানান, ইতোমধ্যে প্রকল্প এলাকায় ঠিকাদারের ক্যাম্প, আবাসন, ব্যাচিং প্ল্যান্ট ও গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া পতেঙ্গা অংশে একটি সাইট অফিস নির্মাণ করা হয়েছে। পতেঙ্গা ও আনোয়ারায় জমি অধিগ্রহণ কাজও শেষ পর্যায়ে। পুরোদমে চলছে মাটি ভরাটের কাজ।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের জন্য মোট প্রয়োজনীয় ভূমির পরিমাণ ৩৮৩ দশমিক ০৯৮৫ একর। এরই মধ্যে ২৩১ দশমিক ৯৯ একর ভূমি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে হস্তান্তর করা হয়েছে। আরও ১৫১ দশমিক ০৯৮৫ একর জমি এখনও অধিগ্রহণের পর্যায়ে আছে।
এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১০৫৫ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৮ হাজার ৪৪৬ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা আড়াই হাজার কোটি টাকার মতো। চীন সরকার দিচ্ছে ৭০৫ দশমিক ৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে মূল টানেলের পুরো নির্মাণ ব্যয় বহন করছে চীন সরকার।
ঋণচুক্তি অনুযায়ী চায়না এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে প্রথম দফায় ১৪১ দশমিক ১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওয়া গেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ১১০৮ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে এ টাকা ঠিকাদারি সংস্থা চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে (সিসিসিসি) বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। খুব দ্রুতই আরও প্রায় ৭শ থেকে ৯শ কোটি টাকার ঋণ ছাড়ের সম্ভাবনাও রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
প্রকল্পটির আওতায় তিন দশমিক চার কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল ছাড়াও পূর্ব প্রান্তে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ও পশ্চিম প্রান্তে ৭৪০ মিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হবে। ফলে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৫ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার কথা চীনের। বাকি অর্থ সরকারি তহবিল থেকে যোগান দেয়া হবে। এ বাবদ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় (এডিপি) এ প্রকল্পে ১ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। চলতি অর্থবছরে এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হয় ১ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা।
সূত্রমতে, চীনের ঋণে দুই শতাংশ সুদহার ছাড়াও দশমিক ২০ শতাংশ কমিটমেন্ট চার্জ ও দশমিক ২০ শতাংশ ম্যানেজমেন্ট চার্জ দিতে হবে। পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছরে পরিশোধ করতে হবে পুরো ঋণ। নির্মাণ ব্যয়ের বাইরে টানেলের জন্য জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন বাবদ দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। আর টানেল নির্মাণকালীন চার বছরে সুদ বাবদ ৪২৯ কোটি টাকা লাগবে। এছাড়া রয়েছে গাড়ি ক্রয়, পরামর্শকসহ অন্যান্য ব্যয়।
প্রসঙ্গত, এ প্রকল্পটি বর্তমান সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার। ২০০৮ সালে লালদীঘি ময়দানে কর্ণফুলী তলদেশে টানেল নির্মাণের ঘোষণার পর; ২০১০ সালে প্রস্তাবটি প্রকল্প আকারে উত্থাপন করা হয়। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই রিপোর্ট চূড়ান্ত হওয়ার পর স্থান নির্বাচন নিয়ে কেটে যায় আরও দুই বছর। ২০১৪ সালের শেষ দিকে এসে কর্ণফুলীর মোহনায় টানেল নির্মাণে একমত হন নগরবিদ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরামর্শক ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা।
টানেল নির্মাণে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সিসিসিসির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পসহ মোট ৬টি প্রকল্পের ভিত্তিফলক উদ্বোধন করেন।
সৌজন্যে- জাগো নিউজ