সিউল শহর থেকে দক্ষিণ-পূর্বে দুই ঘণ্টার পথ। চেরিগাছ সুশোভিত পাহাড়ে বাংলো ধরনের একটি সুন্দর স্কুল ভবন। গাঢ় রঙের ইটের তৈরি। কাঠ দিয়ে তৈরি এর মেঝে চকচক করে। উজ্জ্বল রঙের দেয়ালগুলোতে সারি সারি বই আর খেলনা সাজানো। সবই আছে এই স্কুলে। কিন্তু একটা জিনিসের তীব্র অভাব, তা হলো শিক্ষার্থী। চল্লিশ বছর আগে খনি এলাকা হিসেবে এই অঞ্চলের পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল। ওই সময় এই এলাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয় বোবাল প্রাথমিক বিদ্যালয়। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল তিন শতাধিক। এখন সেই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী আছে মাত্র তিনজন। এদের দুজন ছাত্র ও একজ ছাত্রী। খালি চেয়ার-টেবিল পড়ে আছে অবহেলিতভাবে। বেশির ভাগ সময় বিদ্যালয় থাকে বন্ধ। ইতিমধ্যে বিদ্যালয়টি ১০ কিলোমিটার দূরের একটি শহরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গ্রামের কিছু মানুষ মন্ত্রণালয়ের এই পরিকল্পনা প্রতিরোধের চেষ্টায় বিদ্যালয়ে সমবেত হওয়ায় বিদ্যালয়টি এখন খোলা থাকছে। বর্তমানে স্কুলে তিনজন শিক্ষার্থীর মধ্যে যে ছাত্রীটি আছে, তার বাবা কিম ইয়ং-হুন বলেন, ‘কমিউনিটির জন্য স্কুলটি রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ কিম ও তাঁর অনুসারী গ্রামবাসীরা বিদ্যালয়টি দূরে সরিয়ে নেওয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনাকে তাদের গ্রামের ওপর বড় ধরনের আঘাত বলে দেখছেন।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই পদক্ষেপ বড় প্রবণতারই লক্ষণ। ১৯৮০-এর দশকের প্রথম দিকে দেশটিতে সাড়ে তিন হাজারের বেশি বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। চলতি বছর আরও ২৮টি বিদ্যালয় বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর একটাই কারণ, তা হলো দক্ষিণ কোরিয়ায় শিশুর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। গত বছর দেশটিতে শিশু জন্মের হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ দশমিক শূন্য ৫, যা পৃথিবীতে সবচেয়ে কম। অথচ দেশটির বর্তমান জনসংখ্যা ধরে রাখতে শিশু জন্মের হার প্রয়োজন প্রায় ২ দশমিক ১। এর মধ্যে আবার রাজধানী সিউলে এই জন্মহার মাত্র শূন্য দশমিক ৮৪। দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকেরা এখনো প্রতিবেশী জাপানের মতো বিশাল সংখ্যায় প্রবীণ হননি, তবে তাঁদের চেয়ে দ্রুত বেশি সংখ্যায় প্রবীণ হতে চলেছেন।
জনসংখ্যাবিদদের অধিকাংশই এই পরিস্থিতির জন্য সামাজিক রীতিনীতি ও যুবসমাজের পছন্দ-অপছন্দের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য সৃষ্টি হওয়াকে দোষারোপ করছেন। তাঁদের মতে, দক্ষিণ কোরিয়ায় নারীরা এখন পুরুষদের চেয়েও বেশি শিক্ষিত এবং নারী-পুরুষ ও বেতনবৈষম্য সত্ত্বেও তাঁরা কর্মক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য বেশি মরিয়া হয়ে উঠেছেন। দেশটিতে এখনো একজন নারী গড়ে একজন পুরুষের ৬৩ শতাংশ বেতন-ভাতা পান।
ইয়নসেই ইউনিভার্সিটির লি ডো-হোন বলেন, ‘অনেক কোম্পানি এখনো নারীদের অস্থায়ী কর্মী মনে করে। ওই সব কোম্পানির মালিকদের ধারণা, নারীরা সন্তান জন্মদানের পরপরই চাকরি ছেড়ে দেবেন। এ কারণে নারীরাও সংসারজীবন শুরুর পর আর চাকরিতে ফিরতে পারবেন না বলে উদ্বিগ্ন থাকেন।’
বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একটি পরিবার গড়া বেশ কঠিন। যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার এখন ১০ দশমিক ৫। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিধারী যুবকেরা এখন আর ভালো চাকরির আশা করেন না এবং ভালো চাকরি পেলেও তা আজীবনের জন্য আঁকড়ে থাকতে চান না। অথচ এই যুবকেরাই ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের ৬৯ শতাংশ। ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ছাড়া সবার জন্যই সিউলে একটি ঘরের মালিক হওয়া নাগালের বাইরে চলে গেছে। অথচ এই শহরেই অধিকাংশ অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
অনেকের কাছে এখন বিয়ে খুব একটা সুখকর বিষয় নয়। পুরুষেরা পরিবারকে সহায়তা করতে সক্ষম হবেন না বলে উদ্বিগ্ন থাকেন। আবার নারীরা সম্ভাব্য বরকে সেকেলে ধরনের চাওয়া-পাওয়ার চিন্তাধারার বলে অভিযোগ করেন। বিয়ের মধ্যস্থতা করার ঘটকালি কোম্পানিগুলোও ভালো দায়িত্বে চাকরিরত ও গৃহস্থালি কাজে পর্যাপ্ত দক্ষ নন—এমন পাত্রীদের পয়েন্ট কমিয়ে ধরছে। সিউলের একটি এনজিওতে কর্মরত এক নারী বলেন, ‘বিয়ের অর্থই যেন পুরুষটি আশা করে তুমি বাসায় থাকবে এবং তাঁর জন্য রান্নাবান্না করবে। কেন আমি তা করতে চাইব?’ এত কিছু সত্ত্বেও বিবাহবহির্ভূত সন্তান নেওয়াকে সমাজে এখনো লজ্জাকর হিসেবে দেখা হয়।
এদিকে শিশুর অভাবে সরকারের পেনশন-ব্যবস্থা ও দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হুমকির মুখে রয়েছে। বিগত সরকারগুলো এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার প্রচেষ্টায় বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এসবের বেশির ভাগই মানুষের বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন-হাইয়ের প্রশাসন ২০১৬ সালে জন্মহার বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করার চেষ্টায় দেশের সবচেয়ে বেশি ফার্টাইল (শিশু জন্ম) এলাকাগুলোর নাম উল্লেখ করে একটি ‘বার্থ ম্যাপ’ প্রকাশ করে। এ নিয়ে বেশ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে নারীরাই এর বিরোধিতা করেছেন বেশি। তাঁরা বলেছেন, এর ফলে নারীদের ফার্মের প্রাণীর মতো বিবেচনা করা হয়েছে।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে-ইন অবশ্য ভিন্ন প্রক্রিয়া নির্ধারণ করবেন বলে মনে হয়। তাঁর সরকার ইতিমধ্যে শিশুসেবা উন্নয়ন ও সিঙ্গেল প্যারেন্ট পরিবারের জন্য সহায়তা বৃদ্ধির বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছে। মুন ব্যাপক হারে নারী-পুরুষ সমতা এবং কর্মস্থলের অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনার পক্ষে কাজ করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এতে শুধু জন্মহার বৃদ্ধিই নয়, বরং জীবনধারণের পদ্ধতি বাছাই করার মানুষের স্বাধীনতাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। লি বলেন, এই আশ্বাস জন্মহার বৃদ্ধিতে কিছুটা সহায়তা করতে পারে। তবে কেউ সন্তান নেবেন কি না, এ সিদ্ধান্ত সরকার নির্ধারণ করে দেবে, নারীরা তা মানতে চায় না। তাঁরা চান, তাঁরা যাতে সন্তান নিতে পারেন, সরকার এমন পরিস্থিতি তৈরি করুক।
তবে সরকার কাম্য লক্ষ্য অর্জনের জন্য শহরের পুরুষদের সঙ্গে এশিয়ার গরিব দেশগুলো থেকে ‘আমদানি’ করা কনেদের মধ্যে বিয়ের আয়োজনেও সাহায্য করছে। তাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে এই পদক্ষেপ শুধু শিশু জন্মদানেই নয়, বরং ভালোভাবে অন্য কাজ সম্পাদন করতে বিদেশিদের প্রয়োজনীয়তা মেনে নেওয়া হচ্ছে। তবে ব্যাপক হারে অভিবাসন একটি স্পর্শকাতর বিষয় হিসেবেই রয়ে গেছে। সৌজন্যে- প্রথম আলো।