একের পর এক ফেবারিটের বিদায় ঘটছে রাশিয়া বিশ্বকাপ থেকে। প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়েছে জার্মানি। দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে আর্জেন্টিনা ও পর্তুগালের পর এবার রাশিয়ার কাছে টাইব্রেকারে হেরে বিদায় নিলো আরেক ফেবারিট স্পেন।
নির্ধারিত ৯০ মিনিট ১-১ গোলে সমতা। খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। ১২০ মিনিটের খেলা সমতায় থাকার পর টাইব্রেকারে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিলো ২০১০ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়নরা। কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গেলো রাশিয়া।
টাইব্রেকার নামক ভাগ্যের হেরে বিদায় নিতে হলো স্পেনকে। পুরো ম্যাচে ৭৯ ভাগ বল দখল ছিল স্পেনের। মাত্র ২১ ভাগ ছিল রাশিয়ার। তবুও স্বাগতিকদের জাল খুঁজে পায়নি স্পেনের কোনো শট। রাশিয়ান গোলরক্ষক ইগোর আকিনফিভ ছিলেন ইনিয়েস্তা-ইসকোদের সামনে যেন চীনের মহাপ্রাচীর। কোনো শটই তিনি গোললাইন অতিক্রম করতে দেননি।
শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার জয়ের নায়কে পরিণত হলেন ইগোর আকিনফিভ। দুটি শট ঠেকিয়ে দিলেন তিনি। স্পেনের স্ট্রুাইকার কোকে এবং ইয়াগো আসপাসের শট ঠেকিয়ে নায়কে পরিণত হলেন তিনি। টাইব্রেকারে প্রথম শট নিতে আসেন স্পেনের ইনিয়েস্তা। গোল করেন তিনি, ১-০। রাশিয়ার ফেদর সমোলভ নেন প্রথম শট। এটাও গোল ১-১। পরের শট নিতে আসেন স্পেনের জেরার্ড পিকে। এটাও গোল ২-১। রাশিয়ার হয়ে দ্বিতীয় শট নেন সার্জেই ইগনাশেভিক। এটাও গোল ২-২।
স্পেনের হয়ে তৃতীয় শট নিতে আসেন কোকে। বাম পাশে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার শট ঠেকিয়ে দেন আকিনফিভ, ২-২। রাশিয়ার হয়ে তৃতীয় শট নেন আলেকজান্ডার গলোভিন ২-৩। এটাও গোল। স্পেনের হয়ে চতুর্থ শট নেন সার্জিও রামোস। গোল, ৩-৩। রাশিয়ার হয়ে চতুর্থ শট নেন ডেনিস চেরিশেভ। গোল, ৩-৪। স্পেনের হয়ে পঞ্চম শট নিতে আসেন ইয়াগো আসপাস। এই শটটি ঠেকাতে ঝাঁপিয়ে পড়লেও পেছনের পা দিয়ে ঠেকিয়ে দেন রাশিয়ার গোলরক্ষক আকিনফিভ। ৪-৩ ব্যবধানে জিতে স্পেনকে বিদায় করে দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গেলো স্বাগতিক রাশিয়া।
দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম দুই ম্যাচ নির্ধারিত ৯০ মিনিটের মধ্যে শেষ হওয়ার হলেও, তৃতীয় ম্যাচে এসেই অতিরিক্ত সময় এবং টাইব্রেকারে দেখা পেল রাশিয়া বিশ্বকাপ। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে স্বাগতিক রাশিয়া ও স্পেনের মধ্যকার ম্যাচের নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষে স্কোর ১-১। ম্যাচের নিষ্পত্তির জন্য দ্বারস্থ হতে হয় অতিরিক্তি ৩০ মিনিটের। এই ৩০ মিনিটেও কেউ কারও জালে বল প্রবেশ করাতে পারেনি। ফলে ম্যাচে গড়ায় টাইব্রেকারে।
প্রথমার্ধে হওয়া দুটি গোলই কিন্তু দিয়েছে রাশিয়া। কিন্তু প্রথমার্ধ শেষ হয় ১-১ গোলে। অর্থাৎ স্বাগতিক ডিফেন্ডার সার্গেই ইগনাশেভিক নিজেই নিজেদের জালে বল জড়িয়ে দেন। খেলার ১২ মিনিটেই আত্মঘাতী গোলের কারণে পিছিয়ে পড়ে রাশিয়া।
ডান উইং থেকে ফ্রি কিক নেন ইসকো। তার শট থেকে ভেসে আসা বলটি রিসিভ করার জন্য বক্সের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন রামোস। তাকে ট্যাকল করছিলেন ইগনাশেভিক। তিনি রামোসকে নিয়ে পড়ে যান। এ সময়ই ইগনাশেভিকের পায়ে লেগে বল জড়িয়ে যায় রাশিয়ার জালে। ১-০ গোলে পিছিয়ে পড়ে রাশিয়া।
গোল হজম করার পর সেটি শোধ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে রাশিয়া। যদিও তাদের আক্রমণগুলো ছিল কাউন্টার অ্যাটাকে। সারাক্ষণ স্পেনের আক্রমণ ঠেকিয়ে একটা-দুটা বল নিয়ে উপরে উঠে আসতে পেরেছিল তারা। যার ফলে ৪০তম মিনিটেই পেনাল্টি আদায় করে নেয় রাশিয়া। কর্নার থেকে ভেসে আসা বলে আর্তেম জিউভা হেড করেন। সেই হেডই হাতে লাগে জেরার্ড পিকের। রেফারি সঙ্গে সঙ্গে পেনাল্টির নির্দেশ দেন।
৪১ মিনিটে পেনাল্টির স্পট কিক নিতে আসেন আর্তেম জিউভা নিজেই। স্পেন গোলরক্ষক ডেভিড ডি গিয়াকে পরাস্ত করে গোল করেন জিউবা। এ অবস্থাতেই শেষ হয় ম্যাচের নির্ধারিত ৯০ মিনিট। এরপর ৩০ মিনিটের অতিরিক্ত সময়। মোট ১২০ মিনিটের খেরা ১-১ গোলে ড্র থাকার পর খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে।
প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে গোলের দারুণ সুযোগ পেয়েছিলেন দিয়েগো কস্তা। নাচোর কাছ থেকে বল পেয়ে ডান পায়ের দারুণ শট নিয়েছিলেন কস্তা। কিন্তু সেই বলটি ঠেকিয়ে দেন রাশিয়া গোলরক্ষক।
মুহূর্ত পরেই ইসকোর ক্রস থেকে ভেসে আসা বলে আবারও হেড করেছিলেন কস্তা। কিন্তু এবারও রাশিয়া গোলরক্ষক সেই বলটি ফিরিয়ে দিয়ে রক্ষা করেন দলকে। গোলে সমতা থাকলেও পুরো প্রথমার্ধ আধিপত্য বিস্তার করে খেলেছে স্পেনই। প্রথমার্ধের ৭৫ ভাগ বল দখল ছিল তাদের কাছে। বাকি ২৫ ভাগ রাশিয়ার দখলে। প্রথমার্ধেই ৪৫৮টি পাস দেয় স্প্যানশিরা। রাশিয়ার এই সংখ্যা ১৪৯টি। রাশিয়া টার্গেটে শট নেয় ৩টি, স্পেনও নেয় সমান ৩টি।
দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নেমে গোল পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে দুই দল। শুরুতেই একটি করে পরিবর্তন করে নেয় দুই দল। ৪৬তম মিনিটে ইউরি ঝিরকজভের বদলে মাঠে নামেন ভ্লাদিমির গ্রানাত।
প্রথমার্ধের মতোই রাশিয়ান দুর্গে একের পর এক আক্রমণ হানতে থাকে স্পেন। কিন্তু রাশিয়ার জমাট রক্ষণের সামনে অসহায়ই দেখাচ্ছিল ডিয়েগো কস্তা, ইসকো, আসেনসিওদের। স্প্যানিশদের মুহুর্মুহু আক্রমণ প্রতিহত করেও যেন কোনো ক্লান্তি ছিল না স্বাগতিক ফুটবলারদের মধ্যে।
৬৫তম মিনিটে জিউভাকে বসিয়ে স্মলোভকে নামান রাশিয়ান কোচ। এর মিনিট চারেক আগে মাঠে আসেন চলতি বিশ্বকাপে রাশিয়ানদের নায়ক চেরিশেভ। ৬৭তম মিনিটে স্পেনের পক্ষে নামেন আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। ম্যাচের শুরুর একাদশে থাকা ডেভিড সিলভার বদলে ইনিয়েস্তাকে নামান স্প্যানিশ কোচ হিয়েরো।
মিনিট তিনেক পর নাচোর বদলে কারভাহালকে নামিয়ে দেন হিয়েরো। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছিল না স্পেনের পক্ষে। ম্যাচের ৭১তম মিনিটে প্রথমার্ধে আত্মঘাতী গোল করা ইগনাশেভিক আবারও করে বসেন বাচ্চাসুলভ ভুল। তবে সে যাত্রায় কর্ণারের মাধ্যমে বেঁচে যায় স্বাগতিকরা।
এর মিনিট তিনেক বাদে খেলার ধারার বিপরীতে আক্রমণে ওঠে রাশিয়া। তবে স্পেনের রক্ষণের সাথে পেরে উঠতে ব্যর্থ হন রাশিয়ান ফরোয়ার্ডরা। পুনরায় রাশিয়ান রক্ষণে হানা দিতে শুরু স্পেন।
ম্যাচের চিত্র দেখে মনে হচ্ছিল পুরো মাঠটা যেনো ভাগ করা দেয়া হয়েছে দুইভাগে। যেখানে এক পাশে নিজেদের গোলবারের নিচে একা একা দাঁড়িয়ে স্প্যানিশ গোলরক্ষক ডেভিড দি গিয়া ও অন্য পাশে রেফারিসহ মোট ২২ জন মানুষ ব্যস্ত ফুটবল খেলায়।
৮০তম মিনিটে অবাক করা সিদ্ধান্তে কস্তাকে উঠিয়ে নেন স্প্যানিশ কোচ। তার বদলে মাঠে আসেন আসপাস। মাঠে নেমেই যেন স্পেনের আক্রমণে বাড়তি গতি যোগ করেন তিনি। ৮৫তম মিনিটে ইনিয়েস্তার ডি-বক্সের বাইরে থেকে নেয়া দূরপাল্লার শট দুর্দান্ত ক্ষিপ্রতায় ঠেকিয়ে দেন রাশিয়ান গোলরক্ষক। ফিরতি বলে শট নেন আসপাস, সেটিও ঠেকিয়ে দেন আকিনফিভ।
ম্যাচের বাকি সময়টা কোনোমতে গোল খাওয়া থেকে বেঁচে থাকে রাশিয়া। স্প্যানিশদের ছন্নছাড়া আক্রমণে থেমে যায় ম্যাচের গতি। নির্ধারিত ৯০ মিনিটের পর যোগ করা ৪ মিনিটেও কোনো সুবিধা করতে পারেনি স্প্যানিশরা।
অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে এককভাবে খেলেছে স্পেন। একাদশে ইনিয়েস্তা না থাকলেও তাকে মাটে নামানো হয়। স্পেনের খেলার গতি ফিরে আসে এবং একের পর এক আক্রমণ করেও গোল আদায় করতে পারেনি তারা। শেষ পর্যন্ত খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে।